1. admin@banglahdtv.com : Bangla HD TV :
সোমবার, ১৫ এপ্রিল ২০২৪, ০৫:৩২ অপরাহ্ন

মিয়ানমারে অভ্যুত্থানের নেপথ্যে

Coder Boss
  • Update Time : শুক্রবার, ১৯ ফেব্রুয়ারী, ২০২১
  • ৩৮৫ Time View
অভ্যুত্থানবিরোধী বিক্ষোভ

মিয়ানমারের দীর্ঘ এক দশকের নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্রকে অভ্যুত্থানের ‘টেক্সটবুক এক্সামপল’ মাধ্যমে পরিসমাপ্তি ঘটানো হয়েছে। এই অভ্যুত্থান একটি আকস্মিক হামলা।

যেদিন মিয়ানমারের নতুন জাতীয় পার্লামেন্টের প্রথম অধিবেশন আহ্বান করা হয়েছিল, সেদিনই খুব সকালের দিকে ‘তাতমাদাউ’ নামে পরিচিত সামরিক বাহিনী গত নভেম্বরে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে জালিয়াতির অভিযোগ এনে ক্ষমতা দখল করার ঘোষণা দেয়। তারা আনুষ্ঠানিকভাবে স্টেট কাউন্সিলর তথা দেশটির ডি ফ্যাক্টো লিডার তথা কার্যকর নেতা অং সান সু চি এবং অন্যান্য সিনিয়র নেতা ও বিশিষ্ট রাজনৈতিক ও সামাজিক ব্যক্তিদের গ্রেফতার করেছে। তাতমাদাউ এক বছরের জরুরি অবস্থা ঘোষণা করতে গিয়ে সংবিধানের কথা উল্লেখ করেছে। উল্লেøখ্য, সেনাবাহিনীই ২০০৮ সালে এই সংবিধান প্রণয়ন করেছিল। সংবিধান অনুসারে ইতোমধ্যেই ক্ষমতাধর কমান্ডার ইন চিফ তথা সেনাপ্রধান জেনারেল মিন অং হ্লাইং অত্যাবশ্যকভাবে একজন স্বৈরশাসক হিসেবে আবির্র্ভূত হলেন। তিনি ‘সুষ্ঠু ও ন্যায়নিষ্ঠভাবে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিকাশ সাধনের’ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন এবং অনির্ধারিত তারিখে অপর একটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরিকল্পনার কথা ঘোষণা করেছেন। প্রশ্ন হলো, এটা কেন এবং এখন কেন? সামরিক বাহিনী পরিকল্পিতভাবে একটি সঙ্কট সৃষ্টি করেছে- যাতে তারা পুনরায় নিজেদেরকে ‘সংবিধান ও দেশের ত্রাণকর্তা’ দাবি করতে পারে। এভাবে তারা তাদের একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় রাজনৈতিক শত্রুকে ঘায়েল করার কৌশল নিয়েছে। কিন্তু তারা হয়তো এই কাজ করতে গিয়ে খুব দেরি করে ফেলেছে। কেবল জনসমক্ষে উপস্থিত হওয়ার পরই তারা তাদের এই অপরিপক্ব ক্ষমতার পুরস্কার পাবে।

অং সান সু চির ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্র্যাসি ২০১৫ সালের নির্বাচনে বিপুল বিজয় অর্জন করে এক মেয়াদ ক্ষমতায় থাকার পর সম্প্রতি আবারো নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে জয়লাভ করেছিল। গত নভেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে কোভিড-১৯ মহামারী সত্ত্বেও ৭০ শতাংশেরও বেশি বৈধ ভোটার ভোটদানে অংশগ্রহণ করেন। তারা এনএলডির পক্ষে ৮০ শতাংশেরও বেশি ভোট দিয়েছেন। কার্টার সেন্টার থেকে পিপলস অ্যালায়েন্স ফর ক্রেডিবল ইলেকশন্সসহ আন্তর্জাতিক এবং অভ্যন্তরীণ পর্যবেক্ষকরা এই নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছে বলে ঘোষণা করেছেন। এটা হলো প্রশাসনের পক্ষ থেকে অকাট্য ও জনপ্রিয় অনুমোদন।

এখনো সামরিক বাহিনীর হাতে অফুরন্ত ক্ষমতা সাংবিধানিকভাবে নিশ্চিত করা আছে। স্বরাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা এবং সীমান্ত-বিষয়ক মন্ত্রণালয়গুলো তাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। জাতীয় ও আঞ্চলিক পরিষদের ২৫ শতাংশ আসন সামরিক বাহিনীর জন্য সংরক্ষিত রাখা হয়েছে। সংবিধানের প্রধান প্রভিশনগুলো তথা মূলনীতি সংশোধনীর ক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর ভেটো দেয়ার ক্ষমতা রয়েছে। তাতমাদাউয়ের অর্থনৈতিক স্বার্থের ওপর কারো স্পর্শ লাগেনি। তাদের জন্য বিশাল প্রতিরক্ষা বাজেট এবং হোল্ডিং কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে তাদের আয়ের ব্যবস্থা রয়েছে। তারা দৃঢ় আস্থার সাথে সারা দেশে বিভিন্ন গ্রুপের সাথে লড়াই চালিয়ে যেতে পারে। কারণ তাদেরকে এ জন্য আইনগত কোনো বাধার মুখে পড়তে হবে না। সব ক্ষমতা তাদের হাতের মুঠোয় থাকার পরও কেন তারা আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমতা দখল করল? সুতরাং সহজভাবে ক্ষমতা দখল করে অভ্যুত্থান ঘটিয়ে কি তারা নিজেদের আরো ক্ষতি করল না?

অং সান সু চি এবং জেনারেল মিন অং হ্লাইংয়ের মধ্যে অনেক বৈরিতা রয়েছে। ২০১৫ সালের পর থেকে দু’জনের মধ্যে তেমন একটা দেখাসাক্ষাৎ হয়নি।

গত তিন দশক ধরে নিরাপত্তা বাহিনী এনএলডিকে ধ্বংস করার প্রচেষ্টা চালিয়ে আসছে। তারা এনএলডির শতশত সদস্যকে গ্রেফতার, তাদের ওপর বর্বর নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করেছে অথবা দেশ থেকে বের করে তাদের প্রবাসে পাঠিয়ে দিয়েছে। এবারের অভ্যুত্থানকে কিছু কিছু ক্ষেত্রে দুই এলিট বৌদ্ধ জাতিগোষ্ঠীগত সংখ্যাগরিষ্ঠদের মধ্যকার প্রতিযোগিতা হিসেবে দেখা হচ্ছে। উভয় এলিট গোষ্ঠীই জন্মগতভাবে দেশ শাসনের মানসিকতা পোষণ করে থাকে। এ সবের বাইরে আপাত দৃষ্টিতে যেটা সত্য সেটা হলো : অং সান সু চির পার্টি গত পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকাকালে সাংবিধানিকভাবে, আইনগতভাবে অথবা আর্থিকভাবে সামরিকবাহিনীর ক্ষমতা মারাত্মকভাবে খর্ব করা থেকে ‘অত্যাবশ্যক’ভাবে বিরত ছিল।

এনএলডি বিবর্তনমূলক আইন বাতিল করতে ব্যর্থ হওয়ায় অথবা রাজবন্দীদের ব্যাপারে কথা বলতে না পারায় এবং মিডিয়ার ওপর আক্রমণ বন্ধ করতে না পারায় কর্মীদের সমালোচনার মুখে পড়ে যায়। মিয়ানমারের রাজনৈতিক সংগঠক এবং পশ্চিমা বিশ্লেষকরা সিভিল সোসাইটি, সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবীদের পক্ষে কাজ করতে না পারায় অং সান সু চিকে দায়ী করেন। এনএলডির কিছু সদস্য আমার কাছে স্বীকার করেছেন, গত পাঁচ বছরে সেনাবাহিনীর এই ধারণা জন্মেছে যে, জেনারেলদের প্রতিক্রিয়াকে এড়িয়ে গিয়ে প্রশাসন মনে হচ্ছে একটি গণতন্ত্রায়ন কর্মসূচিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এরপর নভেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে এ পার্টি বিজয় লাভ করার মাধ্যমে দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় বসার জন্য দ্রুত অপর একটি ম্যান্ডেট লাভ করেছে। এতে ক্ষমতার ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যাচ্ছে দেখতে পেয়ে ‘তারা’ হতাশ হয়ে পড়েন। অন্তত তাতমাদাউয়ের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল এরকমই। ফলে সামরিক বাহিনীর অহঙ্কার এবং সুযোগ-সুবিধা হুমকির মুখে পড়ে। ক্ষমতার দৃশ্যপট থেকে নিজেদের হারিয়ে যাওয়ার এই আশঙ্কা থেকেই সামরিক বাহিনী আচমকা অভ্যুত্থানের পথ বেছে নেয়।

সম্ভবত বিশেষভাবে এবং ব্যক্তিগতভাবে জেনারেল হ্লাইংয়ের জন্যই এই অভ্যুত্থান ঘটানো হয়েছে। তিনি চলতি বছর পদত্যাগ করার কথা ছিল। তার অবসরে যাওয়ার বয়স ৬০ বছর পাঁচ বছর আগেই অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। এখন তার বয়স ৬৫ বছর। কূটনীতিকরা আমাকে ব্যক্তিগতভাবে জানান, তিনি দায়িত্ব ছেড়ে দিলে অন্তত আন্তর্জাতিকভাবে বিচারের মুখোমুখি হতে পারেন বলে আশঙ্কা করেছিলেন। রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে জাতিগত নির্মূল অভিযান চালানোর ব্যাপারে নেতৃত্ব দেয়ায় তিনি এই আশঙ্কা করেন।

এ ছাড়াও, এমনকি অং সান সু চি এ পর্যন্ত গণহত্যার অভিযোগ থেকে তাকে অথবা সেনাবাহিনীকে বাঁচানোর জন্য এগিয়ে আসবেন বলে মনে হচ্ছিল না। অবশ্য তিনি ২০১৯ সালে আন্তর্জাতিক আদালতের সামনে তাদের পক্ষে সাফাই গেয়েছিলেন।

অভ্যুত্থান সম্পর্কে একটি খোলামেলা প্রশ্ন হলো- সামরিক বাহিনীর মধ্যে কি এই অভ্যুত্থান খুব একটা জনপ্রিয়তা পেয়েছে? গত নভেম্বরের নির্বাচনে সু চি যে ব্যাপক সমর্থন পেয়েছেন, সেখানে সেনাদের সমর্থন রয়েছে। তারাও এনএলডির পক্ষে ভোট দিয়েছেন। এর পক্ষে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো ডাটা দেখাতে পারব না। তবে সু চির পার্টি জয়লাভ করেছে এমন একটা আসনের কথা উদাহরণ হিসেবে পেশ করতে পারি। ওই আসনটি হলো দেশের পূর্বাঞ্চলের শান স্টেটের কেনতুং টাউনশিপ। আঞ্চলিক ও জাতীয়ভাবে ওই নির্বাচনী এলাকায় আঞ্চলিক সামরিক কমান্ডের বাড়ি এবং হাজার হাজার সেনার বসবাস রয়েছে।

ন্যূনতম একটি অভ্যুত্থান ঘটানোর মাধ্যমে সেনাদের মধ্যকার সংহতি ও নৈতিক মানকে অবজ্ঞা করা হতে পারে এবং এতে সেনাবাহিনী অনেক পিছিয়ে যেতে পারে। কয়েকটি জাতি-গোষ্ঠীগত গ্রুপের সাথে দশকের পর দশক ধরে সশস্ত্র সঙ্ঘাতে সাধারণ সেনাদের মধ্যে অনেকেই হতাহত হয়েছেন। তাই সেনাবাহিনীতে পক্ষত্যাগ বা পলায়নের মনোবৃত্তিও বৃদ্ধি পেয়েছে। অভ্যুত্থানের পর জেনারেলরা কি এই ইনস্টিটিউশনের কাছ থেকে পূর্ণ সমর্থন আশা করতে পারেন?

স্বৈরশাসকের নোংরা ও সস্তা ইমেজ ব্যবহার করে জেনারেল মিন অং হ্লাইং নতুন জান্তা হিসেবে আবির্র্ভূত হয়ে হয়তো তার নিজের নিয়তি বা পরিণতি ব্যর্থ করে দিয়েছেন। কিছু সময়ের জন্য এভাবে চললেও এই অঘটনের মধ্যে হয়তো প্রকৃত ক্ষমতা নিহিত থাকছে। তাতমাদাউ এখন ব্যাপক অস্থিতিশীলতার ঝুঁকিতে পড়েছে। তারা নিজেদের বাহিনীর সদস্যসহ গোটা জাতির সাথে সঙ্ঘাতের প্রকৃত চ্যালেঞ্জের মুখে।

লেখক : নিরপেক্ষ বিশ্লেষক, মিয়ানমারের ব্যাপারে ২০ বছরের অভিজ্ঞ।
নিউ ইয়র্ক টাইমস থেকে ভাষান্তর : মুহাম্মদ খায়রুল বাশার

Please Share This Post in Your Social Media

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category
© All rights reserved © 2020 banglahdtv
Design & Develop BY Coder Boss