জাতীয় সংসদে উত্থাপিত বাজেট প্রসঙ্গে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল ও সাবেক এমপি অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেছেন, অর্থমন্ত্রীর চমকপ্রদ কাগুজে বক্তব্যের সাথে বাস্তবতার কোনো মিল নেই।
অর্থমন্ত্রী আ.হ.ম মোস্তফা কামাল বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে ২০২১-২২ অর্থ বছরের জন্য ছয় লাখ তিন হাজার ৬৮১ কোটি টাকার বাজেট পেশ করার পর সন্ধ্যায় প্রতিক্রিয়া জানিয়ে এক বিবৃতিতে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল এ কথা বলেন। নতুন বাজেটকে উচ্চাকাঙ্ক্ষী ও ঋণনির্ভর বাজেট পেশ বলেও মনে করে জামায়াতে ইসলামী।
অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, অর্থমন্ত্রী জাতীয় সংসদে ঋণনির্ভর ঘাটতি বাজেট পেশ করেছেন। বাজেটের শিরোনাম করা হয়েছে ‘জীবন-জীবিকায় প্রাধান্য দিয়ে সুদৃঢ় আগামীর পথে বাংলাদেশ’। বলা হয়েছে এটি হবে জীবন ও জীবিকার বাজেট এবং সর্বাধিক গুরুত্ব পাবে স্বাস্থ্য সুরক্ষা, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও সামাজিক নিরাপত্তা সম্প্রসারণ। অর্থমন্ত্রীর এ চমকপ্রদ কাগুজে বক্তব্যের সাথে বাস্তবতার কোনো মিল নেই।
বিবৃতিতে বলা হয়, বাজেটে প্রদ্ধির হার ধরা হয়েছে ৭ দশমিক ২ ভাগ, আর বাজেট ঘাটতি হচ্ছে জিডিপির ৬ দশমিক ২ ভাগ। মূল্যস্ফীতি ধরা হয়েছে ৫ দশমিক ৩ ভাগ। প্রস্তাবিত বাজেট ও প্রবৃদ্ধির হার বাস্তবতা বিবর্জিত ও কল্পনা নির্ভর।
বাজেটে আয় ও ব্যয়ের মধ্যে বিশাল ব্যবধান রয়েছে উল্লেখ করে জামায়াত সেক্রেটারি জেনারেল বলেন, চলতি বাজেটের বেশিরভাগই সরকার বাস্তবায়ন করতে পারেনি। প্রস্তাবিত বাজেটে মোট এডিপি ধরা হয়েছে দুই লাখ ২৫ হাজার ৩২৪ কোটি টাকা, রাজস্ব খাতে আয় ধরা হয়েছে তিন লাখ ৮৯ হাজার কোটি টাকা। গত অর্থবছরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের দায়িত্ব ছিল তিন লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব সংগ্রহের। এটি অর্জন সম্ভব নয় জেনে পরে লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে তিন লাখ এক হাজার কোটি টাকা করা হয়। কিন্তু গত ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) রাজস্ব সংগ্রহ হয়েছে মাত্র এক লাখ ৯৭ হাজার ৫৮৩ কোটি টাকা। সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা থেকেও সংগ্রহ এক লাখ তিন হাজার ৪১৭ কোটি কম, যা আদায় করার কথা মে ও জুন এ দুই মাসে। তা কখনো সম্ভব নয়।
প্রস্তাবিত বাজেটের প্রতিক্রিয়ায় জামায়াতের বিবৃতিতে আরো বলা হয়েছে, বাজেটে বৈদেশিক ঋণ ধরা হয়েছে ৯৮ হাজার কোটি টাকা, যা গত বছরের তুলনায় অনেক বেশি। ব্যাংক ঋণ ধরা হয়েছে, ৭৬ হাজার ৪৫২ কোটি টাকা। ঘাটতি ধরা হয়েছে দুই লাখ ১৪ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা। বাজেটের এক তৃতীয়াংশেরও বেশি ঋণনির্ভর। এই ঋণের সুদ পরিশোধ করতেই সরকারের নাভিশ্বাস উঠে যাবে।
জামায়াতে ইসলামী মনে করে, এ বাজেটের মাধ্যমে সরকারের ব্যাংক নির্ভরতা পূর্বের মতো আরো বৃদ্ধি পাবে। অর্থনৈতিক মন্দার কারণে গত বছর ব্যাংকিংখাত থেকে সরকার যে পরিমাণ ঋণ নেয়ার কথা ছিল তা নিতে পারেনি। করোনা পরিস্থিতির কারণে দেশের ব্যাংকিংখাতে অর্থনৈতিক মন্দা বিরাজ করছে। এ বছর বাজেটে ব্যাংক থেকে ৭৬ হাজার ৪৫২ কোটি টাকা ঋণ নেয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। এর মাধ্যমে ব্যাংকিং খাতকে আরো সঙ্কটের দিকে ঠেলে দেয়া হবে।
বিবৃতিতে বলা হয়, সরকারের প্রস্তাবিত এ বাজেটে দেশের আর্থিক শৃঙ্খলা আরো ভেঙে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৭ দশমিক ২ ভাগ। গত বছর জিডিবি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ৮ দশমিক ২ ভাগ, যা অর্জন করা সম্ভব না হওয়ায় জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার সংশোধন করে তা ৫ দশমিক ৩ ভাগ নির্ধারণ করা হয়। অর্থমন্ত্রী প্রবৃদ্ধি নিয়ে আশার বাণী শোনালেও তা বাস্তবতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় বলেও মনে করে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী।
সাবেক এমপি অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার আরো বলেন, করোনাভাইরাসে সংক্রমিত গোটা দেশ। প্রতিদিনই আক্রান্ত ও মৃত্যুবরণ করছে মানুষ। করোনায় আক্রান্ত রোগীরা এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতাল ঘুরে শেষ পর্যন্ত বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুবরণের ঘটনাও ঘটছে। চিকিৎসা ব্যবস্থার এ ভঙুর পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ৩২ হাজার ৭৩১ কেটি টাকা, যা বাজেটের ৭ দশমিক ৪ ভাগ। দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা বর্তমানে অত্যন্ত নাজুক অবস্থায় রয়েছে। হাসপাতালগুলোতে পর্যাপ্ত চিকিৎসা সামগ্রী নেই। মানুষ চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। স্বাস্থ্যখাতে প্রস্তাবিত বরাদ্দ মোটেই যথেষ্ট নয়।
জামায়াত সেক্রেটারি জেনারেল বলেন, আমরা মনে করি, চলমান পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ বাজেটের ১০ ভাগ হওয়া দরকার। চলতি অর্থ বছরে স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ রয়েছে ২৯ হাজার ২৪৭ কোটি টাকা, যার ২৬ ভাগ মাত্র স্বাস্থ্যখাতে ব্যয় হয়েছে। তাই শুধু বাজেটে বরাদ্দ দিলেই হবে না, তা বাস্তবায়নে সরকারের পক্ষ থেকে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
বিবৃতিতে বলা হয়, করোনা পরিস্থিতির অজুহাতে দীর্ঘ ১৪ মাস যাবত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ রয়েছে। স্কুল, কলেজ, মাদরাসা ও বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকায় শীক্ষার্থীরা জ্ঞানের আলো ও শিক্ষা অর্জনের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ক্রমেই দেশ মেধাহীনতার দিকে অগ্রসর হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণামূলক কার্যক্রম নেই বললেই চলে। প্রস্তাবিত বাজেটে এ ব্যাপারে কোনো দিক নির্দেশনা নেই। অর্থমন্ত্রীর বেসরকারি কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর ১৫ ভাগ করারোপের প্রস্তাব শিক্ষাব্যবস্থাকে আরো ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাবে।
এতে আরো বলা হয়, দারিদ্র্য দূরীকরণ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও সামাজিক নিরাপত্তা বলয় গড়ে তোলার জন্য প্রস্তাবিত বাজেট বক্তৃতায় গুরুত্ব দিলেও এ ক্ষেত্রে যে বরাদ্দ রাখা হয়েছে তা বাস্তবায়নের কোনো সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবনা বা রূপরেখা তুলে ধরা হয়নি। বাজেটে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীসহ সকলের জন্য খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করার গতানুগতিক বক্তব্য ছাড়া নতুন কোনো ব্যবস্থার কথা বলা হয়নি।
কৃষিখাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৩১ হাজার ৯১১ কোটি টাকা। কৃষি বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধান চালিকা শক্তি। কৃষকরা বরাবরই তাদের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য পায়না। প্রস্তাবিত বাজেটে উৎপাদনের উপকরণের মূল্য হ্রাসের কোনো কথা বলা হয়নি। রাসায়ণিক সারের মূল্য কমানো, কৃষকদের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত সহ কৃষিখাতকে যথাযথ গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হয়নি।
বাংলাদেশে শিল্প খাত অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় করছে। ক্ষুদ্র, মাঝারি ও কুটির শিল্পে প্রায় আড়াই কোটি মানুষ সম্পৃক্ত। এ খাতকে প্রস্তাবিত বাজেটে যথাযথ গুরুত্ব দেয়া হয়নি।
চলতি অর্থবছরে করোনার কথা চিন্তা করে ১০ হাজার কোটি টাকার একটি বিশেষ তহবিল রাখা হয়েছিল। আগামী অর্থবছরেও ১০ হাজার কোটি টাকার করোনা তহবিল থাকছে। এই তহবিলের টাকা কোথায় কিভাবে খরচ করা হবে সে ব্যাপারে বাজটে স্পষ্ট করে কিছু বলা হয়নি। করোনা ফান্ডের টাকা নিয়ে যে ঘটনা ঘটেছে তা অত্যন্ত দুঃখজনক। এমনকি এই খাতের অর্থ আত্মসাতের কারণে অনেককে জেলেও যেতে হয়েছে। এ ছাড়া করোনার টিকা সংগ্রহ ও বিতরণ নিয়ে দেশে যে সঙ্কট তৈরি হয়েছে তা জাতি হিসেবে আমাদের জন্য অত্যন্ত লজ্জাজনক। আমরা মনে করি করোনার টিকা সংগ্রহ ও বিতরণে আরো স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা দরকার।
করোনা ভাইরাসের কারণে বিপুল সংখ্যক প্রবাসী বাংলাদেশী কর্মহীন হয়ে দেশে প্রত্যাবর্তন করেছে। এ সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলছে। তাদের মধ্যে অনেকেই দেশে ফিরে এসে অত্যন্ত মানবেতর জীবনযাপন করছে। রেমিট্যান্স যোদ্ধা হিসেবে পরিচিত এসকল মানুষের পুনর্বাসনের জন্য বাজেটে কোনো দিক নির্দেশনা নেই।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় যে বরাদ্দ রাখা হয়েছে তা পর্যাপ্ত নয়। বাজেট বক্তৃতায় দেশে বিভিন্ন সময় প্রাকৃতিক দুর্যোগে দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের ব্যাপারে কিছু বলা হয়নি। প্রতিবছর ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস ও বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে উপকূলীয় এলাকার বাঁধ ভেঙে কৃষিজমি, মাছের ঘের ভেসে যাওয়া ও রাস্তা-ঘাট-ব্রিজ-কালভার্ট-বেড়িবাঁধ নির্মাণ ও ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পুনর্বাসনে কোনো বরাদ্দের কথা বাজেটে বলা হয়নি।
করমুক্ত আয়ের সীমা পূর্বের ন্যায় তিন লাখ টাকা রাখা হয়েছে। প্রায় সকল খাতেই আয় ও ব্যয়ের অংক বাড়ানো হলেও, করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়ানো হয়নি। আমরা মনে করি, করোনা ভাইরাসের এই বিপর্যয়কর পরিস্থিতিতে করমুক্ত আয়ের সীমা অন্তত চার লাখ টাকা হওয়া উচিত।
বাজেটে কালো টাকা সাদা করার যে প্রস্তাব করা হয়েছে তা দুর্নীতিকে উৎসাহিত করবে। মূলত দলীয় ও দলীয় পছন্দের লোকদের কালো টাকার পাহাড়কে সাদা করার সুযোগ দেয়ার জন্য বাজেটে এ প্রস্তাব রাখা হয়েছে। আমরা মনে করি যারা অবৈধভাবে অর্থ উপার্জন করে কর ফাঁকি দিয়েছেন, তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনের মাধ্যমে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া দরকার।
বাংলাদেশ একটি মুসলিম দেশ। অথচ আমরা লক্ষ্য করছি যাকাতের টাকার উপর কর আদায় করা হয়। আমরা যাকাতের টাকা করমুক্ত করা প্রয়োজন বলে মনে করি। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে শ্রমিকদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। শ্রমিকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য বাজেটে কোনো বরাদ্দের কথা বলা হয়নি। শ্রমিকদের স্বাস্থ্য, আবাসন ও স্বাস্থ্য বীমার বিষয়ে বাজেটে ব্যবস্থা থাকা দরকার বলে আমরা মনে তরি।
বিবৃতিতে জামায়াতে ইসলামির সেক্রেটারি জেনারেল বলেন, সর্বোপরি করোনাভাইরাসে বিপর্যস্ত অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের জন্য কার্যকর সুশাসন, স্বচ্ছতা নিশ্চিতকরণ ও সকল স্তরে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
বিজ্ঞপ্তি
Leave a Reply