1. admin@banglahdtv.com : Bangla HD TV :
বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৯:৩০ অপরাহ্ন

‘নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন’ নীরবে বাস্তবায়ন

কামরুজ্জামান সিদ্দিকী, নির্বাহী সম্পাদক
  • Update Time : বুধবার, ৩০ জুন, ২০২১
  • ২২৫ Time View

করোনা নিয়ন্ত্রণে নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতে মোদি সরকার সেই সাম্প্রদায়িক ইস্যুগুলোতে আশ্রয় খুঁজছে, যা সবসময় তাদের মুক্তির কাজ দিয়ে আসছে। এমন নাজুক পরিস্থিতি যখন সরকারের তাদের নিজেদের সব মনোযোগ দেশের জনগণকে করোনা থেকে রক্ষা ও ভ্যাকসিনের মারাত্মক ঘাটতি পূরণে নিবদ্ধ করা উচিত। সে সময় তারা জনগণের দৃষ্টি অন্য দিকে ফেরানোর জন্য সাম্প্রদায়িক ইস্যুগুলোতে উজ্জীবিত করছে। নতুবা এর কী কারণ থাকতে পারে যে, হঠাৎ এই নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন বাস্তবায়নের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলো? গত বছর পুরো দেশে এ নিয়ে নজিরবিহীন বিক্ষোভ হয়েছে। এর ধারাগুলো সম্পূর্ণরূপে নাগরিকত্বের সাংবিধানিক ধারার সাথে সাংঘর্ষিক।

সবাই জানেন, আমাদের সংবিধানে নাগরিকত্ব অর্জনের ভিত্তি মোটেও ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নয়। বরং এর মাপকাঠি অন্য। কিন্তু বর্তমান সরকার নাগরিকত্বকে ধর্মের সাথে জুড়ে দিয়ে নিজেদের সাম্প্রদায়িক এজেন্ডাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কাজ করেছে। নাগরিকত্ব আইনের মাঝে ২০১৯ সালে যে সাম্প্রদায়িকসুলভ সংশোধন করা হয়েছে, তার আলোকে প্রতিবেশী রাষ্ট্র পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও বাংলাদেশ থেকে আগত হিন্দু, শিখ, খ্রিষ্টান ও বৌদ্ধ সম্প্রদায় ভারতীয় নাগরিকত্ব পেয়ে যাবে। পক্ষান্তরে মুসলমানরা তা থেকে বঞ্চিত থাকবে। ধর্মীয় বিভেদ ও গোঁড়ামির ওপর প্রতিষ্ঠিত এই সংশোধনের বিরুদ্ধে গত বছর দেশে যে মারাত্মক আন্দোলন হয়েছিল এবং তাতে লাখ লাখ নাগরিক অংশগ্রহণ করেছিলেন, তার প্রেক্ষাপটে আশা করা হয়েছিল, সরকার এই বিতর্কিত ও বিভেদ সৃষ্টিকারী আইন থেকে নিজেদের হাত গুটিয়ে নেবে এবং বিক্ষোভকারীদের দাবি নিয়ে গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করবে। কিন্তু সরকার এমন কিছুই করেনি, বরং সম্প্রতি এই আইন ভিন্ন নামে বাস্তবায়নের নির্দেশ জারি করে দিয়েছে।

মে মাসের শেষের দিকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে। ওই বিজ্ঞপ্তিতে আফগানিস্তান, বাংলাদেশ ও পাকিস্তান থেকে আগত অমুসলিম শরণার্থীদের জন্য ভারতের নাগরিকত্ব পাওয়ার জন্য দরখাস্ত চাওয়া হয়েছে। ওই বিজ্ঞপ্তিতে গুজরাট, রাজস্থান, ছত্তিশগড়, হরিয়ানা ও পাঞ্জাবের ১৩টি জেলায় বসবাসরত হিন্দু, শিখ, জৈন, বৌদ্ধ, পারসিক ও খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের লোকদের ভারতের নাগরিকত্ব দেয়ার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। ওই জেলাগুলোর কালেক্টরদের ওই শরণার্থীদের নাগরিকত্বের সনদ দেয়ার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। পাঞ্জাব ও হরিয়ানার চিফ সেক্রেটারিদেরও ওই লোকদের দরখাস্ত গ্রহণ ও নাগরিকত্বের সনদ প্রদানের শর্তযুক্ত ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জারিকৃত বিজ্ঞপ্তিতে নাগরিকত্ব অর্ডিন্যান্স ১৯৫৫ ও ২০০৯-এর অধীনে প্রস্তুতকৃত কার্যবিধি অনুসরণের কথা বলা হয়েছে। অথচ নতুন নাগরিকত্ব সংশোধনী অর্ডিন্যান্সের (সিএএ) আলোকে এখনো কার্যবিধি তৈরি করা হয়নি, যা সরকার ২০১৯ সালের নভেম্বরে পার্লামেন্ট থেকে পাস করিয়ে নিয়েছে এবং এটা ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে প্রয়োগ করা হচ্ছে। এই আইন অনুযায়ী বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান থেকে আগত ওই সব অমুসলিম শরণার্থীদের ভারতের নাগরিকত্ব দেয়া হবে, যারা ২০১৪ সালের ডিসেম্বরের আগে ভারতে এসেছে।

ভাবনার বিষয় হচ্ছে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সদ্য যে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে, তাতে প্রচলিত নাগরিকত্ব অর্ডিন্যান্স ১৯৫৫ ও ২০০৯-এর অধীনে প্রস্তুতকৃত কার্যবিধি অনুসরণের কথা বলে তার মধ্যে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের কার্যবিধি শামিল করে নেয়া হয়েছে এবং শুধু অমুসলিম শরণার্থীদের কাছে দরখাস্ত আহ্বান করা হয়েছে। এতে এটা প্রমাণিত হয় যে, সরকার বিতর্কিত সিএএ আইনকে পেছনের দরজা দিয়ে বাস্তবায়নের চেষ্টা চালাচ্ছে। যদি আপনি গভীরভাবে ভেবে দেখেন, তাহলে দেখতে পাবেন এই সরকারের সবচেয়ে বড় পরিচিতি হচ্ছে- এরা কখনো জনগণের অভিমতকে সম্মান করে না; সর্বদা নিজেদের মনমতো চলছে। বিষয়টি বিতর্কিত নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের বাস্তবায়ন হোক কিংবা বিতর্কিত কৃষি আইনের হোক, এই দুটি সাম্প্রতিক সময়ে গৃহীত এমন দু’টি আইন, যার বিরুদ্ধে মারাত্মক জনবিক্ষোভ হয়েছে। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে আক্রান্ত ব্যক্তিদের শঙ্কা ও সংশয় দূর করার পরিবর্তে তাদের কণ্ঠস্বর শক্তির জোরে দাবানোর চেষ্টা করা হয়েছে। কৃষকরা এখনো কৃষি আইনের বিরুদ্ধে রাস্তায় বিক্ষোভ করছে। কিন্তু সরকার তাদের একটি কথাও শুনতে প্রস্তুত নয়। অনুরূপভাবে, নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী যে নজিরবিহীন বিক্ষোভ হয়েছে, তা দমনের সম্ভাব্য সব ধরনের চেষ্টা করা হয়েছে। এমনকি তাদের মাঝে নেতৃপর্যায়ের ব্যক্তিদের সন্ত্রাসবিরোধী আইন ইউএপিএর আওতায় এনে গ্রেফতার করে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়েছে। দিল্লি­তে সিএএবিরোধী অনেক নেতৃপর্যায়ের ব্যক্তিকে নর্থ ইস্ট দিল্লি সংঘর্ষের অপরাধী বানিয়ে গ্রেফতার করা হয়েছে, যাতে তাদের মনোবল ভেঙে দিয়ে সরকার নিজের মতো করে সব কিছু করতে পারে। বলা হয়ে থাকে, নর্থ ইস্টের সংঘর্ষ বাঁধানোর এটাই উদ্দেশ্য ছিল। এতে পঞ্চাশের অধিক নিরাপরাধ ব্যক্তি নিহত হয়েছে এবং কয়েক হাজার ব্যক্তি বন্দী হয়েছে। বিভিন্ন শহরে যারা নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে অংশ নিয়েছিল, তাদের বিরুদ্ধে কঠিন দফার আলোকে মামলা করা হয়েছে এবং তাদের স্থাবর সম্পত্তি ক্রোক করা হয়েছে।

সাধারণ ধারণা ছিল, সরকার করোনা অতিমারীর কারণে বিতর্কিত নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের বাস্তবায়ন থেকে হাত গুটিয়ে নিয়েছে। কিন্তু এ ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। সরকার তাদের এজেন্ডায় ফিরে এসেছে এবং তারা ধর্মীয় বিভেদ ও উগ্রতার ওপর প্রতিষ্ঠিত এই আইন বাস্তবায়নের জন্য কোভিড পরিস্থিতিকে ব্যবহার করছে। এ কথা সবাই জানেন, ভারত এ সময় জরুরি চিকিৎসার সময় পার করছে। করোনার এই ভয়ানক অতিমারীর আঘাতে এখন পর্যন্ত তিন লক্ষাধিক মানুষ মারা গেছে। কোটি কোটি মানুষ এতে আক্রান্ত হয়েছে। এখনো অপর্যাপ্ত চিকিৎসা সহায়তার কারণে রোগী দ্বারে দ্বারে ঘুরতে বাধ্য হচ্ছে। এমনকি করোনায় মৃতদের লাশের শেষ আনুষ্ঠানিকতাও একটি কঠিন সঙ্কটে রূপ নিয়েছে। এর সবচেয়ে মর্মান্তিক ও অমানবিক দৃশ্য দেখা গেছে উত্তরপ্রদেশে। সেখানে হাজার হাজার লাশ গঙ্গার তীরে ভাসতে দেখা গেছে ও বালুতে চাপা পাওয়া গেছে। ভ্যাকসিনের সরবরাহও একটি বড় সঙ্কটে পরিণত হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে সরকার দেশের মুসলিম নাগরিকদের পৃথক করতে ব্যস্ত যাতে এই সমস্যা থেকে জনগণের দৃষ্টি সাম্প্রদায়িক ইস্যুগুলোর প্রতি সরানো যায় এবং আরো একবার তাদের চোখে ধুলা ছিটাতে পারে।

এ বিষয়টি চিন্তার যে, সিএএর বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে অসংখ্য আবেদন ঝুলে আছে। আদালত এখনো এগুলোর ওপর শুনানি শুরু করেনি। এমন পরিস্থিতিতে ভিন্ন নামে তার বাস্তবায়নের বিজ্ঞপ্তি জারি করা কতটুকু বিধিসম্মত? নাগরিক আইন ১৯৫৫-এর অধীনে নাগরিকত্ব সনদ দেয়ার ক্ষমতা ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত জেলা কালেক্টরদের কাছেই ছিল। কিন্তু আসাম সমঝোতার পর এটা প্রত্যাহার করে নেয়া হয়। এ ব্যাপারে সর্বশেষ সিদ্ধান্ত কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সংরক্ষিত করে দেয়া হয়েছে। তবে বৈধ ভিসা, পাসপোর্টের মাধ্যমে আগত সংখ্যালঘু অধিবাসীদের সমস্যা বৃদ্ধি পেতে দেখে ২০১৬ সালে কেন্দ্র প্রচলিত নাগরিক আইন ১৯৫৫-এর ১৬ নম্বর ধারার বিশেষ ক্ষমতাকে ব্যবহার করে ১৬টি জেলার কালেক্টরদের পুনরায় সেই ক্ষমতা বহাল করে দেয়। এখন সেখানে আরো ১৩টি জেলার কালেক্টরদের যুক্ত করা হয়েছে।

অর্থাৎ ২৯টি জেলার কালেক্টরদের ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। এ ধরনের আবেদনে চিন্তাভাবনা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণের। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সদ্য বিজ্ঞপ্তিতে ওই সব শঙ্কা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে, যা নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন পার্লামেন্ট থেকে পাস করার পর তৈরি হয়েছিল। সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হচ্ছে, এই দেশে সংবিধানের শাসন কায়েম হবে, নাকি আবারো এক কট্টরপন্থী ও সঙ্কীর্ণ দৃষ্টির সরকারের এজেন্ডা বাস্তবায়ন হবে, যা সম্পূর্ণরূপে মুসলমানদের কোণঠাসা করার নামান্তর। মানবাধিকারের সদস্যদেরও সিভিল সোসাইটির আবারো প্রতিবাদের কণ্ঠস্বর জোরালো করার সময় হয়েছে।

Please Share This Post in Your Social Media

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category
© All rights reserved © 2020 banglahdtv
Design & Develop BY Coder Boss