দেশে করোনার মধ্যেই নয়া আতঙ্ক হিসেবে দেখা দিয়েছে ব্ল্যাক ফাঙ্গাস। ভারতে আতঙ্ক হয়ে দেখা দেয়া এই ফাঙ্গাস সংক্রমণ দেশে ধরা পড়ার তথ্য মিলেছে। এ ফাঙ্গাসে আক্রান্ত হয়ে একজনের মৃত্যু হয়েছে বলেও সন্দেহ করা হচ্ছে। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার পর সুস্থ হয়েছেন দেশে এমন অন্তত ২ জনের শরীরে ‘ব্ল্যাক ফাঙ্গাস’ শনাক্ত হয়েছে।
সমপ্রতি ভারতে বিরল ছত্রাকজনিত এই রোগটি ছড়িয়ে পড়ার পর বাংলাদেশে এ নিয়ে উদ্বেগের মধ্যে ২ জন আক্রান্ত হওয়ার কথা জানা গেল। চলতি মাসে রাজধানীর বারডেম জেনারেল হাসপাতাল থেকে তাদের শরীরে ব্ল্যাক ফাঙ্গাস শনাক্ত করা হয়। বিশ্লেষজ্ঞরা বলছেন, যাদের অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস থাকে, তাদের ঝুঁকি বেশি। ধুলাবালি থেকে হয়ে থাকে এটি। তবে ছোঁয়াচে রোগ নয়।
এটা নাকের ভিতরে কালো হয়ে যায়। সর্দিও কালো হয়। চোখে সংক্রমণ হয়। স্টেরয়েড গ্রহণ করার কারণে হতে পারে। তাই দীর্ঘ সময় স্টেরয়েড গ্রহণ করা যাবে না।
ব্ল্যাক ফাঙ্গাস প্রসঙ্গে গতকাল এক অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, ভারতের নতুন ভ্যারিয়েন্টের পাশাপাশি ব্ল্যাক ফাঙ্গাসও দেশে চলে এসেছে। করোনায় ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট প্রতিরোধের পাশাপাশি এখন ব্ল্যাক ফাঙ্গাসও আমাদেরকে মোকাবিলা করতে হবে। তবে এই মুহূর্তে খুব বেশি ভয়ের কারণ নেই। কারণ এখন পর্যন্ত ভাইরাসটি দেশে ছড়িয়ে পড়েনি। আগাম সতর্কতা হিসেবে দেশের বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানিকে ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের প্রতিষেধক ওষুধ উৎপাদন বৃদ্ধি করতে বলা হয়েছে এবং একই সঙ্গে এই রোগের উপযুক্ত চিকিৎসায় করণীয় কী হবে সে ব্যাপারেও সংশ্লিষ্ট বিভাগকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
এদিকে, বারডেম হাসপাতালের কর্মকর্তারা জানান, গত ৮ই মে ৪৫ বছর বয়সী এক রোগীর শরীরে মিউকরমাইকোসিস বা ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের সংক্রমণ শনাক্ত হয়। এরপর গত ২৩শে মে ৬০ বছর বয়সী আরেক জনের শরীরেও ছত্রাকজনিত রোগটি শনাক্ত হয়। শনাক্ত হওয়া এক ব্যক্তি সাতক্ষীরার কমলনগর গ্রাম থেকে এসেছেন বলেও জানা যায়। তবে ভারত যাওয়ার ইতিহাস জানা যায়নি। বারডেম হাসপাতালে চারদিন আগে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৬৫ বছরের এক বৃদ্ধের মৃত্যু হয়। তিনি ব্ল্যাক ফাঙ্গাসে আক্রান্ত হয়েই মারা যান বলে সন্দেহ করছেন চিকিৎসকরা। তিনি আসলেই এই ভয়াবহ রোগে আক্রান্ত ছিলেন কি-না সে বিষয়ে নিশ্চিত হতে ৭ থেকে ১০ দিন সময় লাগবে। নমুনা কালচারের মাধ্যমে বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যাবে। তবে বর্তমানে হাসপাতালটিতে চিকিৎসাধীন আরেক রোগী ব্ল্যাক ফাঙ্গাসে আক্রান্ত হয়েছেন, এমনটা প্রায় নিশ্চিত বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। তারা বলছেন, নমুনা কালচার করা না হলেও অন্যান্য পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্যারামিটার দেখে ওই রোগী ব্ল্যাক ফাঙ্গাসে আক্রান্ত বলে ধরে নেয়া যায়। তারা ইতিমধ্যেই সে অনুযায়ী রোগীকে চিকিৎসা দিচ্ছেন। শনাক্ত হওয়া আরেকজন রোগী অন্য হাসপাতালে চলে গেছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে হাসপাতালটির রেসপিরেটরি মেডিসিন বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন বলেন, ৬৫ বছরের এক বৃদ্ধ দিন দশেক আগে আমাদের হাসপাতালে ভর্তি হন। তার উচ্চমাত্রার অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস ও কিডনির সমস্যা ছিল। তিনি ইতিপূর্বে করোনায়ও আক্রান্ত হয়েছিলেন। চারদিন আগে তার মৃত্যু হয়। আমরা সন্দেহ করছি যে তার ব্ল্যাক ফাঙ্গাসে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। তিনি আরো বলেন, ওই রোগী কোভিডে আক্রান্ত হয়েছিলেন, ফুসফুসে ইনফেকশন ছিল, উচ্চমাত্রার ডায়াবেটিস এবং কিডনি সমস্যা ছিল। প্রাথমিকভাবে কিছু পরীক্ষার নমুনা পরীক্ষার ফলাফল হাতে এসেছে। ক্লিনিক্যাল ডায়াগনসিস থেকে সন্দেহ করা হচ্ছে ওই রোগীর মৃত্যু ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের কারণেই হয়েছে। কিন্তু কালচার পরীক্ষা না করলে কনফার্ম করতে পারবো না। এতে ৭ থেকে ১০ দিন সময় লাগবে। ডা. দেলোয়ার বলেন, ব্ল্যাক ফাঙ্গাস বা অন্য ফাঙ্গাস পরিবেশেই রয়েছে। আপনার-আমার সবার শরীরেই ফাঙ্গাস রয়েছে। যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ভালো তাদের কিছু হয় না। অন্য যে রোগী ভর্তি রয়েছে তার কালচার পরীক্ষা করা না হলেও তিনি যে ব্ল্যাক ফাঙ্গাসে আক্রান্ত সে ব্যাপারে তারা ৯৫ শতাংশ নিশ্চিত বলে উল্লেখ করেন। ওই রোগীর চিকিৎসাও শুরু হয়েছে বলেও জানান তিনি। ব্ল্যাক ফাঙ্গাসে মারা যাওয়া প্রসঙ্গে বারডেমের যুগ্ম পরিচালক ডা. নাজিমুল ইসলাম বলেন, সন্দেহজনক ব্ল্যাক ফাঙ্গাস। নিশ্চিত নন যে ব্ল্যাক ফাঙ্গাস। মারা যাওয়া রোগীর কালচার না পাঠালে নিশ্চিত ব্ল্যাক ফাঙ্গাস কিনা তা বলা মুশকিল। বারডেম হাসপাতালের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. লাভলি বাড়ৈ গণমাধ্যমকে বলেন, আমাদের ল্যাবে দু’জনের শরীরে মিউকরমাইকোসিস শনাক্ত হয়েছে। আমরা তাদের চিকিৎসা দিচ্ছি এবং ব্লাড সুগার নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করছি। আমরা সতর্কভাবে তাদের পর্যবেক্ষণ করছি উল্লেখ করে ডা. লাভলি বাড়ৈ বলেন, ব্ল্যাক ফাঙ্গাসে আক্রান্ত রোগীর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকলে অবস্থা গুরুতর হতে পারে। তাই তাদের সতর্কভাবে চিকিৎসা দিতে হয়। তিনি আরো জানান, করোনা আক্রান্ত রোগীকে মাত্রা না বুঝে স্টেরয়েড দিলে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যেতে পারে। যার ফলে রোগীর ব্ল্যাক ফাঙ্গাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়।
ব্ল্যাক ফাঙ্গাসে প্রসঙ্গে জাতীয় পরামর্শক কমিটির অন্যতম সদস্য এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম মানবজমিনকে বলেন, যাদের অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস থাকে, তাদের ঝুঁকি বেশি। ধুলাবালি থেকে হয়ে থাকে এটি। তবে ছোঁয়াচে রোগ নয়। এটা নাকের ভিতরে কালো হয়ে যায়। সর্দিও কালো হয়। চোখে সংক্রমণ হয়। তিনি আরো জানান, এটা বিপজ্জনক রোগ। অনেক সময় চোখ নষ্ট হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এজন্য যারা করোনায় বাসা-বাড়িতে চিকিৎসা নিচ্ছেন তাদেরকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে। আবার স্টেরয়েড গ্রহণ করার কারণে হতে পারে। তাই দীর্ঘ সময় স্টেরয়েড গ্রহণ করা যাবে না। এতে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। জাতীয় পরামর্শক কমিটি অবশ্যই এ ব্যাপারে সরকারকে গাইডলাইন দেবে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
অণুজীববিজ্ঞানী, জনস্বাস্থ্যবিদ ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ বলছেন, মিউকোরমাইকোসিস নতুন কোনো ছত্রাক নয়। এই ছত্রাক পরিবেশেই আছে। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম এমন ব্যক্তিদের এই ছত্রাকে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁঁকি বেশি। অধ্যাপক এম দেলোয়ার হোসেন বলেন, যাদের অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস থাকে, তাদের ঝুঁকি বেশি। আবার স্টেরয়েড গ্রহণ করা কোনো কোনো ব্যক্তিও এতে আক্রান্ত হতে পারেন।
যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের (সিডিসি) মতে, মিউকরমাইসিটিস ছত্রাক থেকে মিউকরমাইকোসিস হয়ে থাকে। এটি বাতাসের চেয়ে মাটিতে এবং শীত ও বসন্তকালের চেয়ে গ্রীষ্ম ও শরৎকালে বেশি দেখা যায়। বেশিরভাগ মানুষই প্রতিদিন এই আণুবীক্ষণিক ছত্রাকের স্পোরের সংস্পর্শে আসে। সুতরাং আমাদের এই মিউকরমাইসিটিসের সংস্পর্শ এড়িয়ে চলা প্রায় অসম্ভব। তবে, বেশিরভাগ মানুষের ক্ষেত্রে এই ছত্রাক ক্ষতিকর নয়। যাদের শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম, শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে তাদের শরীরে মিউকরমাইসিটিসের স্পোর প্রবেশ করলে ফুসফুস ও সাইনাস আক্রান্ত হতে পারে। যা পরে শরীরের অন্যান্য অংশেও ছড়িয়ে পড়ে। সিডিসি’র মতে, এই বিরল ছত্রাকে আক্রান্তদের মৃত্যুহার ৫০ শতাংশ। তবে, ৯২৯টি ঘটনা নিয়ে করা ২০০৫ সালের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, মৃত্যুহার ৫৪ শতাংশ। সিডিসি’র গাইডলাইন বলছে, অ্যান্টি ফাঙ্গাল মেডিসিন ব্যবহার করে ব্ল্যাক ফাঙ্গাস চিকিৎসা করা হয়। এসব ওষুধের বেশিরভাগই শিরাপথে দেয়া হয়। সেরে উঠতে রোগীকে ছয় সপ্তাহ পর্যন্ত এই ওষুধ দিতে হতে পারে। তবে, রোগ শনাক্ত ও চিকিৎসা আরম্ভ করা হয়েছে কখন তার ওপর বিষয়টি নির্ভর করে।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, সব বয়সী মানুষের এই ছত্রাকে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁঁকি না থাকায় এ নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার তেমন কিছু নেই। তারা আরো জানান, কোভিড-১৯ ও ডায়াবেটিস আক্রান্ত রোগী, যারা স্টেরয়েড নিচ্ছেন, ক্যান্সার আক্রান্ত অথবা যারা অঙ্গ প্রতিস্থাপন করেছেন, তারা সবচেয়ে বেশি ব্ল্যাক ফাঙ্গাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে আছেন। বিশেষজ্ঞরা আরো জানান, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায় তাই নয়, কোভিড-১৯ চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধের কারণেও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়।
স্বাস্থ্যসেবা অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক ডা. নাজমুল ইসলাম বলেন, কোভিড-১৯ প্রতিরোধে ন্যাশনাল টেকনিক্যাল অ্যাডভাইজারি কমিটি কিছু সুপারিশ তৈরি করছে। একইসঙ্গে স্বাস্থ্যসেবা অধিদপ্তরের স্বাস্থ্যসেবা উপদেষ্টা কমিটিও এই রোগ প্রতিরোধে কিছু বিধিবিধান তৈরি করছে। ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের সংক্রমণের চিকিৎসায় এগুলো খুব শিগগিরই প্রকাশ করা হবে। এ ব্যাপারে সব জেলায় সতর্ক বার্তা দেয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি।
ভারতে মিউকোরমাইকোসিস বা ‘ব্ল্যাক ফাঙ্গাস’ ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়ছে। দেশটিতে এ পর্যন্ত প্রায় ৯ হাজার মানুষ এই ফাঙ্গাসে সংক্রমিত হয়েছেন।
Leave a Reply