রাজনৈতিক প্রভাবে প্রকৃত ঘটনা ও ইনভেস্টিগেশনের সমন্বয় থাকে না। ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬১ ধারা মোতাবেক পুলিশ সাক্ষীর যে জবানবন্দী রেকর্ড করে তাতে অনেকসময় সত্যের অপলাপ হয় এবং এগুলো হয়ে থাকে রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে। প্রভাবান্বিত চার্জশিট দেয়ায় যাদের সাক্ষী করা হয় তাদের পরে আর খুঁজে না পাওয়ার কারণেই বিচার বিলম্বিত হয়, কিন্তু দায়ভার চাপানো হয় এককভাবে বিচার বিভাগের ওপর। বিচারকে দ্রুত সম্পন্ন করার জন্য বিচার বিভাগ এককভাবে দায়ী হতে পারে না। এর পেছনে রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়াও অনেক পারিপার্শ্বিকতা জড়িত, যার ত্রুটি ফাইন্ড আউট করতে গভীর অনুসন্ধান ও বস্তুনিষ্ঠ গবেষণা প্রয়োজন।
ইসলামকে কটাক্ষ করা তথাকথিত প্রগতিবাদীদের ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে। সাম্প্রদায়িক উসকানি বন্ধ করতে হলে এ-জাতীয় ফ্যাশন বন্ধ করতে হবে। প্রকৃত দোষীকে দায়ী করতে হবে, অন্য ধর্মকে দায়ী করা হবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। তাহলে সাম্প্রদায়িকতার মূল উৎপাটিত হবে না, বরং বিষপাপের বীজ অঙ্কুরিত হতেই থাকবে।
বাংলাদেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা অবশ্যই নিন্দনীয়। কোনো কারণেই এসব ঘটনা সমর্থন করা যায় না। তবে সব ঘটনার জন্য ওয়াজ মাহফিল ও মাদরাসার প্রতি কটাক্ষ করে যেসব উদ্দেশ্যমূলক বক্তব্য প্রকাশ করা হয় সেগুলোও সমর্থন করা যায় না। ভারত উপমহাদেশ ৭০০ বছর মুসলমানরা শাসন করেছে, কিন্তু মুসলমান রাজত্বকালে অন্য ধর্মের কোনো উপাসনালয়ে হামলার নজির নেই। তথাপি ধর্মভিত্তিক কোনো ঘটনার জন্য ভারত থেকে তো বটেই বাংলাদেশের অতি প্রগতিশীলরা মুসলমানদের দায়ী করে থাকে। অথচ ভারতে সাম্প্রতিক সময়ে অকারণে মুসলিম নিধন বেশি হচ্ছে। রাষ্ট্রীয়ভাবে ভারত সাম্প্রদায়িকতাকে উসকানি দেয়, বাংলাদেশ যার বিপরীত।
শোষক ও শোষিত, সংখ্যাগুরু ও সংখ্যালঘুর সঙ্ঘাত আজ পৃথিবীব্যাপী, কোথাও বেশি, কোথাও কম, তবে তা সভ্যতার পরিপন্থী। বাংলাদেশের সংবিধান সংখ্যাগুরু-সংখ্যালঘু তারতম্য স্বীকৃতি দেয় না। তারপরও যেকোনো ঘটনার পেছনের শিকড় না খুঁজে পাল্টাপাল্টি অবস্থান নিয়ে তিলকে তাল বানানোর চেষ্টায় লিপ্ত হয়ে আমরা প্রকৃত ঘটনাকে হারিয়ে ফেলি, ফলে দোষী ব্যক্তি আড়ালেই থেকে যাচ্ছে, যে কারণে কোনো কোনো ক্ষেত্রে ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর নির্দোষ ব্যক্তিদের বিচারের জন্য কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়, নামের সাথে জড়িয়ে দেয়া হয় সাম্প্রদায়িকতার লেবাস।
ছাত্রজীবনে পাঠ্যবইয়ের একটি কাহিনী স্মরণ পড়েছে। ঘটনাটি হলো, এক একটি গোষ্ঠী যারা মুসলমান নামধারী তারাও ইসলাম এবং মুসলমান সংস্কৃতির বিরুদ্ধে কথা বলে নিজেদের প্রগতিশীল হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চায়। সম্প্রতি কুমিল্লা, পীরগঞ্জে জেলেপাড়ায় অগ্নিসংযোগ, চানপুর, নাটোর, চৌমুহনীসহ দেশে বিভিন্ন জেলায় পূজামণ্ডপে অনাকাক্সিক্ষত ও বর্বরোচিত হামলার জন্য ইসলাম ধর্মের প্রতি অঙ্গুলি দেখাচ্ছে। সংবিধান থেকে রাষ্ট্রধর্ম ‘ইসলাম’ বাদ দেয়ার কথা অতিমাত্রায় কথিত অসাম্প্রদায়িক সাজে নিজেকে সজ্জিত করার চেষ্টা করছেন অনেকে। ভোটের রাজ্যে বাজিমাত করতে ইসলাম ধর্মের বিরুদ্ধে কথা বলে হিরো সাজার চেষ্টায় লিপ্ত অনেকে। অথচ তাদের জানা উচিত, ইসলাম একটি অসাম্প্রদায়িক ধর্ম এবং হজরত মুহাম্মাদ সা:-এর জীবনীতে সাম্প্রদায়িকতার লেশমাত্র পাওয়া যায় না। কেউ ইসলাম ধর্মে সাম্প্রদায়িকতা খোঁজে অজ্ঞতার কারণে, আবার নিজ স্বার্থ চরিতার্থ করতে কাজটি করেন অনেকে। একজন প্রকৃত মুসলমান সাম্প্রদায়িক নন এবং তা হতে পারে না। সাম্প্রদায়িক বনাম অসাম্প্রদায়িক বিষয়টি এখন রাজনৈতিক খেলায় পরিণত হয়েছে। ধর্মকে যেমন নির্যাতনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা অনুচিত, ঠিক তেমনি সাম্প্রদায়িকতাকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করলে ‘সাম্প্রদায়িকতার চাষাবাদ’ বন্ধ হবে না, বরং বিষপাপ উৎপাদিত হতেই থাকবে।
১৯৬৪ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর আদমজী মিলের বিহারিরা হামলা চালায়। এ হামলা যখন নারায়ণগঞ্জ জেলার আশপাশের গ্রাম পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয় তখন দেখেছি আমাদের বাড়ির মসজিদে হিন্দুদের আশ্রয় দেয়া হয়েছে। বন্দুক নিয়ে বাড়ির লোকজনসহ আমার চাচারা রাতভর মসজিদ পাহারা দিয়েছেন। আমাদের গ্রামটি হিন্দু মুসলমান যৌথ (৫০+৫০ শতাংশ) অবস্থান ছিল। বাংলাদেশের ধর্মভিত্তিক দলগুলোও সম্প্রতি হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর ঘটে যাওয়া ঘটনাকে সমর্থন বা উৎসাহিত করেনি। তার পরও ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোকে নিষিদ্ধ করতে দাবি করা হচ্ছে। ভারতের হিন্দু নেতা তো ইসলাম ধর্মকে সাম্প্রদায়িক বানানোর চেষ্টা করেই যাচ্ছেন। বাংলাদেশের অনেক প্রগতিশীল এ মর্মে বসে নেই।
লেখক : রাজনীতিক, কলামিস্ট আলহাজ্ব মো: জামির হোসেন, সহ-সভাপতি জাতীয়তাবাদী স্বেচ্ছাসেবক দল, কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটি।
Leave a Reply