1. admin@banglahdtv.com : Bangla HD TV :
শনিবার, ০৪ মে ২০২৪, ০১:৪৭ অপরাহ্ন

মিয়ানমার একটা সামরিক ক্লাব

Coder Boss
  • Update Time : শনিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারী, ২০২১
  • ৪৬৮ Time View

গত ১ ফেব্রুয়ারি থেকে মিয়ানমার মানে, বার্মা দেশ আবার দেশী-বিদেশী খবরের শিরোনামে উঠেছে। যদিও রয়টার্স বা বিবিসি বলছে ১ ফেব্রুয়ারি ভোরে মিয়ানমারে নাকি একটা ক্যু হয়েছে। আসলেই কী তাই? না, হয়নি। তাহলে সবাই একে ‘ক্যু’ বলছে কেন?

এটা বলছে কারণ আমেরিকা-ইউরোপের পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো এটা চাইছে, এটা তাদের ‘ভাষ্য’। তারা বার্মায় হিউম্যান রাইট নেই- এই অভিযোগ তুলে জেনারেলদের থেকে ব্যবসা ও সম্পদ লুটেছে আর চেপে গিয়েছিল। এবার কী করে দেখা যাক! আর মিয়ানমারের জেনারেলরা এই উছিলায় চাইছে তাদের ক্লাব নয়, রাষ্ট্র মনে করা হোক এবং তাদের ভাষ্য তাই। তাহলে সমস্যাটা ঠিক কোথায়? সমস্যা হলো, মিয়ানমার একটা দেশ অবশ্যই। কিন্তু এটা জন্ম থেকে কখনোই রাষ্ট্র নয় মানে- মিয়ানমার ১৯৪৮ সালে আগের কলোনি দখলদার জাপান অথবা ব্রিটিশদের থেকে মুক্ত হওয়ার পর থেকেই এটা রাষ্ট্র। আর যেটা আদতে কোনো রাষ্ট্রই নয় তাতে তার আবার সামরিক ক্যু ঘটেছে, এ কথার কী মানে? এ ছাড়া কোনো একটা সংগঠিত সেনাবাহিনী মানে তাদের একটা ‘ক্লাব’ হয়ে থাকা মানেই কি সেটা রাষ্ট্র বলে মানতে হবে? তাহলে ‘রাষ্ট্র’ কী?

খুবই অল্প কথায় বললে, প্রশ্নটা ক্ষমতার, মানে রাষ্ট্রক্ষমতার। শাসন-ক্ষমতাধর যেকোনো শাসককে বলতে পারতে হবে, কে তাকে ক্ষমতা দিয়েছে। মোটা দাগে এখানে দুটা ভাগ দেখতে পাওয়া যায়। এক. যারা ক্ষমতার উৎসের জবাব দিতে পারে না, হদিস দিতে পারে না; যাদের বেলায় উত্তরাধিকার হিসেবে রাজার সন্তান রাজা হয়। এরাই তাদের আদি রাজার ক্ষমতার হদিস না দিতে পেরে দাবি করেন যে ক্ষমতা ‘ঐশ্বরিকভাবে’ পেয়েছে।

আর দুই. যারা হিম্মত রাখে ও বলে ‘ক্ষমতা জনগণের’। সেই জনগণের সম্মিলিত ইচ্ছার প্রতিনিধি, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি হিসেবে তারা ক্ষমতায় আসীন হয়েছে। এই দ্বিতীয় ধারার বেলায় তারা দাবি করতে পারে, তাদের রাষ্ট্র আছে আর সেই দেশে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা একটা রাষ্ট্রগঠন করেছেন, ফলে এরপর একটা সরকার গঠনও করেছে। এই দ্বিতীয় ধারাকেই বলা যায় এটা এক রিপাবলিক বা জনগণের প্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্র। কাজেই রিপাবলিক বাদে আর কোনো দেশেরই ক্ষমতার হদিস থাকে না, উত্তরাধিকারী রাজা-সম্রাটের সন্তানেরা রাজা-সম্রাট হয়ে থাকে। কোথাও কোথাও বড়জোর সমাজের কিছু এলিট মিলে তাদের পছন্দের কাউকে শাসক বানিয়ে রাখে। কোথাও শাসক থাকা মানে তা ‘দেশ’ অবশ্যই; কিন্তু শাসক থাকা মানেই তা ‘রাষ্ট্র’ নয়। দুনিয়াতে যা দেখা গেছে, এই অর্থে ইতিহাসে ১৬৫০ সালের আগে রিপাবলিক রাষ্ট্র বলে কিছু ছিল না।

তবে নিজ ক্ষমতার উৎস কী, কে দিয়েছে তা পরিষ্কারভাবে বলতে পারা বা না-পারা- এটাকেই আমরা কোনো ‘দেশ’কে ‘রাষ্ট্র’ বলেও মানা না মানার মূল নির্ণায়ক বলতে পারি।

কিছু ব্যতিক্রম, ‘নগর-রাষ্ট্র’
তবে ব্যতিক্রম হিসেবে ক্ষণকালের জন্য আমরা কোথাও নগর-রাষ্ট্র ধারণা লক্ষ করি। যেমন যিশুর জন্মের ৭৫৩ বছর আগে ‘প্রাচীন রোমে’ রাজতন্ত্রের পত্তন হয়েছিল। পরে (প্রায় আড়াইশ’ বছর পরে) সেখানে নগর-রাষ্ট্রের ধারণার বাস্তবায়ন শুরু হয়েছিল যিশুর জন্মের ৫০৯ বছর আগে। এটাই প্রথম দীর্ঘস্থায়ী রিপাবলিক। পরে সেটাও ভেঙে যায় যিশুর জন্মের মাত্র ২৭ বছর আগে। এবার ফিরে আবার রাজতন্ত্র বা মোনার্কি মানে, রোমান এম্পায়ার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। টিকেছিল যিশুর জন্মের ৪৭৬ বছর পরে পর্যন্ত। এ সময়েরই মাঝামাঝি রোমে বেড়ে যাওয়া খ্রিষ্টধর্ম সামলাতে ৩১৩ সালে সম্রাট কনস্টান্টিন নিজেই রোমকে ‘খ্রিষ্টান রোম’ বলে ঘোষণা করেন। তখনই তিনিসহ সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিক সদলে এ ধর্মটি গ্রহণ করেছিলেন।

কলোনি দখল হয়ে যাওয়ার মধ্যেও ভালোমন্দ
অনেকে বলে থাকেন, দেশ যদি কলোনি দখলে যায়ই তবে জাপানের কলোনি হওয়ার চেয়ে ব্রিটিশ কলোনি হওয়া ভালো। এমন কেন বলেন?

ব্রিটিশেরা ‘পশ্চিমা’ বলে এশিয়ান জাপানের চেয়ে তারা ভালো, ব্যাপারটা তা নয়। আগে দেখেছি, রোম ‘নগর-রাষ্ট্রও’ টিকে নেই। শেষে তা রোম সাম্রাজ্যের ভেতরে হারিয়ে যায়; যে সাম্রাজ্য আবার ৪৭৬ সালের মধ্যে নিজেই বিলীন হয়ে যায়। কিন্তু পরে ‘হলি রোমান এম্পায়ার’ নামে, ৮০০ সাল থেকে রাজা শার্লেমেন (ফরাসি উচ্চারণে শাআলে-মেঁ) নতুন এক এম্পায়ার চালু করেন। তবে আগের রোমান সাম্রাজ্যের সাথে নয়া হলি রোমান এম্পায়ারের কোনো সম্পর্ক নেই, কেবল নামের কিছু মিল ছাড়া। আর এখনকার জার্মানি-ফ্রান্সের মাঝের ফ্রাঙ্ক ভূখণ্ডকে কেন্দ্র রেখে এর বিস্তার শুরু হয়েছিল। মোটা দাগে, এই সাম্রাজ্যই (৮০০-১৮০৬) এখনকার ইউরোপের প্রায় সব রাষ্ট্রেরই পূর্ব-শাসক ছিল। যদিও শেষের ৩০০ বছর বিশেষত ১৬৪৮ সাল থেকেই এটা নামকাওয়াস্তে সাম্রাজ্য হয়ে গিয়েছিল। এমনকি তা আলাদা আলাদা সাম্রাজ্য বা রাষ্ট্র হয়ে সীমানাও ভাগ করে নিয়েছিল যা এখনকার ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলোর সীমানা নির্দেশ করে।

এভাবে ১৬৫০ সালের ব্রিটেনে ক্রমওয়েলের বিপ্লবকেই (ইংলিশ বিপ্লব) ধরা হয়, প্রথম রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে রিপাবলিক রাষ্ট্রচিন্তার বিজয়। তবে এরপরে সাম্রাজ্যগুলোর ভেতরেই এদের শাসন-কাঠামো কী হবে তা নিয়েও রাষ্ট্র-ধারণার ক্রম-রূপান্তর ঘটেছিল; যেখানে মূল প্রশ্ন ছিল রাষ্ট্রক্ষমতা।

যেমন নাগরিক হলো উপাদান বা কনস্টিটুয়েন্ট। আর এই কনস্টিটুয়েন্টদেরকে দিয়ে রাষ্ট্র কনস্টিটিউট বা গঠন করা- এই ধারণার ওপর রিপাবলিক রাষ্ট্র গঠিত। সার কথায়, পাবলিক বা নাগরিকই রাষ্ট্রক্ষমতার উৎস- এই ধারণা আস্তে ধীরে সমাজগুলোতে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল। এর সাথে সাথে তাই রিপ্রেজেন্টেশন বা প্রতিনিধিত্ব ধারণা প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। এটাই জনপ্রতিনিধিত্বের ধারণা; মাঠে ময়দানের ভাষায় যা ভোট বা নির্বাচন। এখান থেকে রাষ্ট্রের সাথে সম্পর্কিত আরো শব্দ যেমন- জনস্বার্থ, জনস্বাস্থ্য, জনপ্রশাসন, জনপরিবহন অথবা পাবলিক ইন্টারেস্ট লিটিগেশন (জনস্বার্থে মামলা)। আবার এখান থেকেই মাও সেতুংয়ের চীনের ভাষায় তাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নাম পিপলস ব্যাংক, সেনাবাহিনীর নাম পিপলস আর্মি ইত্যাদি। সার কথাটা হলো, রাষ্ট্রক্ষমতার উৎস জনগণ; রাষ্ট্রপরিচালনায় সব ক্ষমতার উৎস জনগণ- এটাই মূল ভিত্তি। এই ধারণাকে মূল ও কেন্দ্রীয় ধারণা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে রাষ্ট্র ধারণার বিস্তার ঘটেছে। তাই না কোনো রাজা, না সম্রাট, না কোনো।

উত্তরাধিকারী বা না সমাজের এলিটদের বেছে নেয়া কেউ প্রমুখ, এরা কেউই ক্ষমতার উৎস নন। রাষ্ট্রক্ষমতার উৎস একমাত্র জনগণ। জনগণের সম্মিলিত ইচ্ছার প্রতিনিধি- নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরাই একমাত্র জনগণের হয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা করতে পারেন। এটাই রিপাবলিক (গণপ্রজাতন্ত্রী) রাষ্ট্র ধারণাটার সারকথা।

কিন্তু রাষ্ট্র ধারণার এদিকটা এশিয়ায় এভাবে বিকশিত হয়নি। একটা মোনার্কি মানে সেখান থেকে ছোট রাজা থেকে বড় সম্রাটের সাম্রাজ্য আর সেখান থেকে মালিক কলোনি দখলদার সাম্রাজ্য হয়ে ওঠার পরে দেখা গেছে, এদের বিকাশ শেষ। যেমন এশিয়ান অরিজিন জাপান, এর সম্পর্কে আমরা খুবই কম জানি বা চর্চা করি। সে মূলত পূর্ব এশিয়ার দুই কোরিয়া ও চীনের আংশিক কলোনি দখলদার এক সাম্রাজ্য এবং সে ব্রিটিশ কলোনি মিয়ানমারের কিছু নেতা আর পশ্চিমবাংলার সাবেক কংগ্রেসি সুভাষ বোস- এদের মাধ্যমে ব্রিটিশ-ভারত কলোনিকে নিজের প্রভাবাধীনে নেয়ার চেষ্টা করার আরেক কলোনি মাস্টার।

কিন্তু জাপান সম্পর্কে এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ আরেক দিক আছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পক্ষ-বিপক্ষের ভাগাভাগীতে জাপান হিটলারের জার্মানির পক্ষে আর আমেরিকা-সোভিয়েত-ব্রিটিশ মিত্রশক্তির বিরুদ্ধে। কিন্তু যুদ্ধে জার্মানির হিটলারের সাথে জাপানও হেরে যায়। কিন্তু আমেরিকা আর সবার মতো ‘হারুপার্টি’ জাপানকেও ত্রাণ এবং অবকাঠামো ও শিল্প পুনর্বাসনের অর্থ দিয়েছিল। আর কেবল সামরিক দিকে আমেরিকার অধীনস্ত থেকে পুনর্গঠিত এক নতুন রাজনৈতিক ব্যবস্থার জাপান গঠন করা হয়েছিল। এই নতুন জাপান নিজেকে রাষ্ট্র দাবি করলেও কিন্তু রিপাবলিক কি না জানা যায় না। এ ছাড়া জাপানে রাজনীতি বলে কিছু আছে কি না, চিন্তায় চর্চায়, তাও জানা যায় না। জাপানের ফরমাল নাম ‘ইউনিয়ন অব জাপান’। অর্থাৎ কোথাও এটা যে ‘রিপাবলিক’ সে কথা বলা হয়নি।

জাপানে রাজনৈতিক চিন্তা ও চর্চার দিক সবসময়ই খুবই দুর্বল। এটা বড় জোর একটা জাতিরাষ্ট্র বা দেশপ্রেম- এই পর্যন্তই, যার কোনো রাজনৈতিকতা নেই। বিশেষত জাপানের কলোনি দখলের পক্ষে নিজ কোনো সাফাই দেয়ার যেন প্রয়োজন-অনুভব নেই। তাদের গায়ের জোর আছে তাই দখল করেছে- এ ধরনের যেটা ব্রিটিশদের মতো নয়।

এর বিপরীতে ব্রিটিশদের রাজনীতি ও রাষ্ট্র নিয়ে ধারণা ছিল। যেমন- রামমোহন রায়, তার চিন্তার সীমাবদ্ধতা ও কমতির শেষ নেই। তবু একটা রাজনৈতিক রাষ্ট্র গড়ার স্বপ্ন ব্রিটিশেরা তাকে এবং অন্য নেটিভদের দিতে পেরেছিল। অবশ্য তা মূলত নেশন-স্টেট ধরনের জাতিবাদী, দেশপ্রেম টাইপের। পাবলিকের ক্ষমতার রাষ্ট্র মানে রিপাবলিক এমন কোনো ব্যাখ্যা সেখানে ছিল না। এ ক্ষেত্রে রামমোহনে চিন্তার সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও একটা রাজনৈতিকতা সেখানে ছিল। এককথায় জনগণই রাষ্ট্রক্ষমতার উৎস ও কেন্দ্র এতটুকু চিন্তার রাজনৈতিকতা ব্রিটিশ কলোনি থেকে পাওয়ার সুযোগ ছিল। কিন্তু জাপানের কলোনি হলে এটুকু রাজনৈতিকতা পাওয়ার সুযোগ নেই।

এদিকটাই মিয়ানমার শাসকদের ভিন্ন করে তুলেছে বলে অনুমান করার সুযোগ আছে। বার্মা কেন রাষ্ট্রই নয়, কোনো রিপাবলিক নয়, এর কারণ আমরা এখানে খুঁজলে পাবো।

তবে মিয়ানমার কেন ব্রিটিশ শাসনবিরোধিতা করতে জাপানের কাছে গিয়েছিল, এর পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ মনে করা হয় দুটা। ব্রিটিশরা বার্মা দখল করেছিল ১৮২৪ সালে, ছেড়ে গিয়েছিল ১৯৪৮ সালে। কিন্তু এই ১২৪ বছরের মাত্র শেষ ১১ বছর (১৯৩৭ সাল থেকে) ছাড়া বাকি সবটা সময় বার্মাকে ব্রিটিশ-ইন্ডিয়ারই একটা প্রদেশ রূপে ঘোষণা করে শাসন করা হয়েছিল। আর ভারতীয় ও ব্রিটিশদের ওপর এটাই বার্মিজদের প্রধান ক্ষোভের কারণ।

এমন প্রদেশ হিসেবে গণ্য করে শাসন করাতে ক্ষমতায় সবার উপরে ব্রিটিশরা থাকলেও মূলত ভারতীয় সিভিল সার্ভিস অফিসারদের অধীনে বার্মা নিজেকে দেখতে পেত। আরো ঘটনা হলো শহর-গঞ্জে ভারতীয়রা বার্মায় ব্যবসায় ও চাকরিতে প্রধান ভূমিকায় নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছিল। যেমন কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্রের গল্প উপন্যাসগুলো মনে করা যেতে পারে যেখানে বার্মার নাম এই কারণেই বারবার এসেছে। ফলে ভারতীয়রা হয়ে যায় বার্মার সাধারণ মানুষের চোখে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ও লুটেরা; যার উপরে কলোনি মালিক ব্রিটিশের ওপর বার্মিজ ঘৃণা তো আছেই।

ফলে বার্মিজ তরুণদের কাছে জাপানের শাসকেরা হাতছানি তৈরি করেছিল এরই পালটা প্রতিক্রিয়ায় যে, তারা জাপানি সাহায্য নিয়ে হলেও ভারতীয় ও ব্রিটিশদের তাড়াবে। ভারতীয়দের ঘৃণা ১৯৪৮ থেকে ’৬০ সাল পর্যন্ত আরো তীব্র হয়েছিল তাদের সমূলে ভারত ফেরত পাঠাতে। তবে তরুণদের জাপানি-প্রীতি বাড়ার আরেক বড় কারণ হলো, ১৯৪১ সালে জাপান থাইল্যান্ড দখল করে নিয়েছিল। আর বার্মার প্রতিবেশী হলো থাইল্যান্ড। সু চির বাবা অং সান ও তার বন্ধুরা প্রায়ই ব্রিটিশদের খোঁজাখুঁজি এড়াতে পালিয়ে আশ্রয় নিতেন থাইল্যান্ডে। আর সেখানেই জাপানি আর্মির সাথে তাদের প্রথম মোলাকাত ঘটেছিল। সেখানেই সাব্যস্ত হয় যে, জাপানিরা তাদের সামরিক ট্রেনিং দেবে। অং সান গোপনে দেশে ফিরে নিজ বন্ধুদের সংগঠিত করে নিয়ে যান। পরবর্তীকালে ট্রেনিংপ্রাপ্ত এরাই হয় ট্রেনার আর বার্মিং ইন্ডিপেন্ডেন্ট আর্মি (বিআইএ) নামে এরা সেনাবাহিনী গড়ে তুলেছিল। পরের বছর ১৯৪২ সালে জাপানিরা বার্মা আক্রমণ করলে এই বাহিনীর সেনারা জাপানিদের পক্ষে পদাতিক যুদ্ধ করেছিল। জাপানিরা ব্রিটিশদের হাত থেকে বার্মাকে স্বাধীন করে ফেলে। এতে বার্মায় সেই জাপানি প্রশাসনে অংশ নিয়েছিলেন অং সান ও তার বন্ধুরা।

কিন্তু নির্ধারক ভূমিকা নিয়েছিল অন্যরা। জাপানিরা অং সানের ৩০০ জন বন্ধুর একটা দলকে বিশেষ ট্রেনিং দিয়েছিল বিআইএ গঠনের সময়। এদের গল্প-বীরত্বই আজো বার্মার আর্মির পুঁজি। পরে জাপানিদের হার স্বীকার করতে হয়েছিল ব্রিটিশদের কাছে। কারণ ১৯৪৫ সালের আগস্টে বিশ্বযুদ্ধের জাপান-জার্মান অক্ষের হার হয়েছিল। ফলে বার্মার ক্ষমতা আবার সেই ব্রিটিশদের হাতে চলে যায়। আর তা থেকেই পরে ১৯৪৮ সালে অং সান (তিনি ১৯৪৭ সালে আততায়ীর হাতে নিহত হয়েছিলেন) ও বন্ধুরা ক্ষমতা নেন, বিশেষত ওই ‘প্রমিন্যান্ট’ ৩০ জন।

কিন্তু বার্মার শাসনে দুর্যোগের দিন শুরু হয় এখান থেকেই। মূলত এই ৩০ জন ভাগ হয়ে যান সিভিলিয়ান রাজনীতিবিদ বা প্রশাসক এবং আর্মি অফিসার- এভাবে। কিন্তু এটাই কাল হয়ে দাঁড়ায়- এ দুই দলের কারা শ্রেষ্ঠ অথবা কাদের ভূমিকা নির্ধারক, এসব নিয়ে। আসলে পেছনের ঘটনাটা ভিন্ন। জাপানি ট্রেনিংয়ে কখনোই রাজনৈতিকতাকে গুরুত্ব দেয়া হয়নি। একই কারণে রাষ্ট্রক্ষমতার ও রাষ্ট্রগঠন সংক্রান্ত ধারণা দেয়া হয়নি। কারণ এসব বিষয়ে জাপানিরা নিজেই দুর্বল ছিল। বরং উলটা আর সবই ছিল ক্ষমতার ধারণা; যেখানে ক্ষমতা মানে কেবল সামরিকতা। রাষ্ট্রধারণা, জনগণ ক্ষমতার উৎস কেন বা জনপ্রতিনিধির ধারণা ইত্যাদি ব্যাপারে কোনো ধারণাই এদের ছিল না। এর ওপর আবার বার্মা মূল ৯টি জাতে বিভক্ত যাদের অন্তত তিনটি গোষ্ঠী ব্রিটিশ আমলেই স্বায়ত্তশাসন উপভোগ করত। কিন্তু স্বাধীন বার্মার জেনারেলরা তা কেড়ে নিয়েছিলেন। এখন এসব জাতিগোষ্ঠীকে কিভাবে মোকাবেলা করা হবে এ নিয়েও লাগে নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব। এসব জটিলতার সমাধান হবে বল প্রয়োগে তা মনে করে, অং সানের আরেক বন্ধু নেউইন যিনি সামরিক জেনারেল ছিলেন, ১৯৬২ সালে সামরিক বলে ক্ষমতা দখল করার ঘোষণা দেন। অর্থাৎ সিভিল রাজনীতিক বনাম আর্মির ভাগ হয়ে থাকার এ ভাব পরিণতি দেন। সেই থেকে দেশের ক্ষমতা আর কখনোই সিভিল রাজনীতিকের হাতে আসেনি।

কথা শুরু করেছিলাম ‘মিয়ানমার কোনো রাষ্ট্র’ নয় বলে। কেন? মিয়ানমার অবশ্যই একটা ‘দেশ’। কিন্তু এই দেশের মালিক যেন একটা ‘ক্লাব’ এবং এটা একটা সামরিক ক্লাব।

বার্মার কনস্টিটিউশনে ‘ডিফেন্স সার্ভিস’ কারা
মিয়ানমারে এখন তৃতীয় কনস্টিটিউশন চলছে। এর সর্বশেষটা রচিত হয়েছে ২০০৮ সালে।
কনস্টিটিউশন ২০০৮ এর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো, এই কনস্টিটিউশনের শুরুতে দ্বিতীয় প্যারায় যে অনুচ্ছেদ, এর শিরোনাম ‘বেসিক প্রিন্সিপল’। এর অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রগঠনের উদ্দেশ্য হিসেবে (এ থেকে এফ) সাতটি উদ্দেশ্যের কথা বলা হয়েছে। আর এর সর্বশেষ এফ বা সপ্তম উদ্দেশ্যই হলো, হাজার কথার এককথা। সপ্তম উদ্দেশ্য হলো, ‘দেশের ডিফেন্স সার্ভিসকে রাষ্ট্রের জাতীয় রাজনৈতিক নেতৃত্বের ভূমিকায় অংশগ্রহণে সক্ষম করা।’

বলেছিলাম বার্মা রাষ্ট্র্র নয় একটা দেশ মাত্র। বলেছিলাম, রাজতন্ত্র করতে গেলে রাষ্ট্রক্ষমতার উৎস জানাতে ব্যর্থ হবে। আর না হলে রিপাবলিক রাষ্ট্র গড়লে বলা সম্ভব, রাষ্ট্রক্ষমতার উৎস জনগণ। সেটা যাই হোক, নির্বাচিতের বেলায় জনপ্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত রাজনৈতিক নেতা হবেন নির্বাহী প্রধানমন্ত্রী বা প্রেসিডেন্ট। আর তার অধীনে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো থাকবে। নির্বাহী প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার অধীনে থাকবে সামরিক বাহিনীসহ সব প্রতিষ্ঠান। এই হলো রিপাবলিক ক্ষমতার কাঠামোগত বিন্যাস। অথচ কনস্টিটিউশনের সপ্তম উদ্দেশ্য বলছে, ‘দেশের ডিফেন্স সার্ভিসকে রাষ্ট্রের জাতীয় রাজনৈতিক নেতৃত্বের ভূমিকায় অংশগ্রহণে সক্ষম করা।’ অর্থাৎ এই বাক্য অর্থহীন ও স্ববিরোধী। ‘ডিফেন্স সার্ভিসের সদস্যরা’ দেশের ‘রাজনৈতিক নেতা’ হবেন কিভাবে?

এই ‘ডিফেন্স সার্ভিস’ বলতে আমাদের মতো রাষ্ট্রকাঠামোর সেনাবাহিনী বলে বুঝা ভুল হবে। কারণ মিয়ানমারের বর্তমান কনস্টিটিউশনের ‘ডিফেন্স সার্ভিস’ বলতে একে সবার উপরের ক্ষমতার এক প্রতিষ্ঠান বলে যদি ধরে নেন তাহলে এরপর এর পুরোটার অর্থ স্পষ্ট হবে। এ জন্যই বলেছি, মিয়ানমারের ‘ডিফেন্স সার্ভিস’ একটা ক্লাবের মতো; তবে সামরিক ক্লাব, যে আবার দেশের মালিক। আর ঠিক এ কারণেই মিয়ানমার কোনো রাষ্ট্রের নাম নয়, রাষ্ট্র নয়।

লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক

Please Share This Post in Your Social Media

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category
© All rights reserved © 2020 banglahdtv
Design & Develop BY Coder Boss