1. admin@banglahdtv.com : Bangla HD TV :
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০:১২ পূর্বাহ্ন

বঙ্গবীর জেনারেল মুহাম্মদ আতাউল গণি ওসমানী

Coder Boss
  • Update Time : সোমবার, ১৫ ফেব্রুয়ারী, ২০২১
  • ৩৫৪ Time View
বঙ্গবীর জেনারেল মুহাম্মদ আতাউল গণি ওসমানী - ছবি : সংগৃহীত

২৫ মার্চের কালরাত্রি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হঠাৎ আক্রমণের আগেই বঙ্গবন্ধু ছাড়াই রাজনীতিবিদরা দেশ ছেড়ে কলকাতায় পালিয়ে গিয়েছিলেন। ইতোমধ্যে বঙ্গবন্ধুকেও গ্রেফতার করা হলে পুরো জাতি যখন নেতৃত্বহীন ও দিশেহারা, ঠিক সে সময়ে দুঃসাহসী এক সেনানায়কের আবির্ভাব ঘটে পাল্টা আক্রমণে নেতৃত্ব দেয়ার জন্য। তিনি জেনারেল মুহাম্মদ আতাউল গণি ওসমানী। বাংলাদেশের ইতিহাসে তিনি কিংবদন্তির মহানায়ক। আজ মুক্তিযুদ্ধের সেই সর্বাধিনায়কের ৩৭তম মৃত্যুবার্ষিকী।

১৯৭১ সালের ৪ এপ্রিল সিলেটের তেলিয়াপাড়া চা-বাগানে ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়কদের নিয়ে এক ঐতিহাসিক বৈঠক করেন জেনারেল ওসমানী। লে. কর্নেল মো: আবদুর রব, মেজর জিয়াউর রহমান, মেজর কাজী মো: শফিউল্লাহ, মেজর খালেদ মোশাররফ, মেজর কাজী নুরুজ্জামান, কর্নেল সালেহউদ্দিন, মোহাম্মদ রেজা, মেজর শাফায়াত জামিল, মেজর মঈনুল হোসেন চৌধুরী, মেজর নূরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন শমসের মবিন চৌধুরী, বেঙ্গল রেজিমেন্টের আরো অনেক অফিসার, ভারতীয় বিএসএফ প্রধান রুস্তমজি ও ব্রিগেডিয়ার পান্ডেসহ আরো অনেক সামরিক ব্যক্তিত্ব ওই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। ওসমানী তার দিকনির্দেশনা ও যুদ্ধপরিকল্পনা সবাইকে অবহিত করেন এবং সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরুর নির্দেশ দেন। এ ঐতিহাসিক বৈঠকেই মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডাররা সর্বসম্মতিতে কর্নেল ওসমানীকে মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক মনোনীত করেন এবং দেশের এ ক্রান্তিলগ্নে রাজনীতিবিদদের একটি অস্থায়ী সরকার গঠনের পরামর্শ দেয়ার জন্য তাকে দায়িত্ব দেয়া হয়। এ মিটিংয়ের সিদ্ধান্তই বদলে দেয় দেশের ভাগ্য। ওসমানীর নেতৃত্বে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। পরবর্তীতে ১৯৭১ সালে ১২ এপ্রিল অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার এক ঘোষণায় কর্নেল ওসমানীকে মুক্তিবাহিনী গঠন করা ও মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্ব দিয়ে কেবিনেট মন্ত্রীর পদমর্যাদায় তাকে বাংলাদেশের সশস্ত্রবাহিনীর সর্বাধিনায়ক ও সেনাবাহিনী প্রধান নিযুক্ত করে শপথ গ্রহণ করানো হয়।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সর্বাধিনায়ক কে? প্রথম সেনাপ্রধান ও প্রথম জেনারেল কে? বাংলাদেশের কোন সেনা অফিসার বিশ্বের চার চারটি বড় যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন এবং তিনটি দেশের সেনাবাহিনীতে চাকরি করার অভিজ্ঞতা ছিল? কোন সামরিক অফিসার অবসরকালীন সময়ে দেশের ক্রান্তিলগ্নে স্বাধীনতা যুদ্ধে সশস্ত্রবাহিনীর নেতৃত্ব দেন? ইত্যাকার মহা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর এ দেশবাসীর অনেকেরই, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের কাছে অজানা। বিরল এ অবস্থানের অধিকারী হলেন জেনারেল মুহাম্মদ আতাউল গণি ওসমানী।

জ্যেষ্ঠতা, অভিজ্ঞতা, দেশপ্রেম, ধর্মীয় মূল্যবোধ ও জাতীয়তাবাদী আদর্শে অনুপ্রাণিত ওসমানীই মুক্তিযুদ্ধের কমান্ডার-ইন-চিফ হিসেবে নিয়োজিত হন মুজিবনগর সরকার কর্তৃক। মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য যুদ্ধবিদ্যার সুনিপুণ কারিগর অসাধারণ সাহসী, তেজস্বী ও নির্ভীক সেনানায়ক জেনারেল ওসমানীর সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও সুদক্ষ নেতৃত্বে দ্রুতগতিতে মুক্তিযুদ্ধ বেগবান হয়। তিনি বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করে গেরিলা যুদ্ধ শুরু করেন। অতঃপর তিনটি নিয়মিত ব্রিগেড (জেড, কে ও এস ফোর্স) সৃষ্টি করেন। কয়েক মাসের ব্যবধানে নবগঠিত বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কাছে বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী যোদ্ধা পাকিস্তানি বাহিনী নাস্তানাবুদ হতে থাকে, বিভিন্ন যুদ্ধে শোচনীয় পরাজয় বরণ করতে থাকে এবং ৯ মাসেরও কম সময়ে বিস্ময়কর বিজয় অর্জিত হয়।

১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের কোয়েটা স্টাফ কলেজ থেকে গ্র্যাজুয়েশন লাভ করেন জে. ওসমানী। ১৯৪৯ সালে চিফ অব জেনারেল স্টাফের ডেপুটি নিযুক্ত হন। ১৯৫০ সালে যশোর সেনানিবাসে ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রথম ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক নিযুক্ত হন এবং চট্টগ্রাম সেনানিবাসে ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টার প্রতিষ্ঠা ও এর পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত তৎকালীন পূর্ববাংলার আরো কয়েকটি আঞ্চলিক স্টেশনের দায়িত্বও তিনি সফলতার সাথে পালন করেন? পরে ১৪তম পাঞ্জাব রেজিমেন্টের নবম ব্যাটালিয়নের রাইফেলস কোম্পানির পরিচালক, ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের (ইপিআর) অতিরিক্ত কমান্ড্যান্টের দায়িত্ব পালন করেন।

১৯৫৫ সালের ১২ ডিসেম্বর পাকিস্তান সেনাসদরে মিলিটারি অপারেশন ডাইরেক্টরেটে জেনারেল স্টাফ অফিসার গ্রেড-১ হিসেবে এবং ১৯৫৬ সালের ১৬ মে কর্নেল পদে পদোন্নতি পেয়ে মিলিটারি অপারেশন ডাইরেক্টরেটে ডেপুটি ডাইরেক্টরের দায়িত্ব নিযুক্ত হন। ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধে তিনি বীরত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। এ সময় তিনি আন্তর্জাতিক সংস্থা সিয়াটো ও সেন্টোতে পাকিস্তান বাহিনীর প্রতিনিধিত্ব করেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কর্মরত থাকাকালীন ওসমানী একজন স্পষ্টভাষী, স্বাধীনচেতা, নির্ভীক কর্মকর্তা হিসেবে পরিচিত ছিলেন এবং বাঙালি সেনাদের অধিকার রক্ষার্থে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন।

তিনি জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘চল চল চল’ গানটিকে ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের মার্চ/রণসঙ্গীত হিসেবে মনোনীত করে সরকারের অনুমোদন লাভে সক্ষম হন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে তিনি অত্যন্ত সম্মান ও মর্যাদার অধিকারী ছিলেন এবং তাকে ‘পাপা টাইগার’, ‘টাইগার ওসমানী’, ‘বঙ্গশার্দূল’ প্রভৃতি নামে অলঙ্কৃত করা হয়েছে। ওসমানী ১৯৬৭ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেন।

ওসমানীর গভীর দেশপ্রেম ও বাঙালিদের অধিকার আদায়ে তার আপসহীন মনোভাব সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু অবহিত ছিলেন। জাতীয় স্বার্থে বঙ্গবন্ধু তাকে রাজনীতিতে যোগ দেয়ার জন্য আহ্বান জানান। ১৯৭০ সালের জুলাই মাসে ওসমানী আওয়ামী লীগে যোগ দেন এবং সাধারণ নির্বাচনে বালাগঞ্জ, ফেঞ্চুগঞ্জ, গোপালগঞ্জ ও বিশ্বনাথসহ চার এলাকায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।

অবসরের প্রায় চার বছর পর মাতৃভূমির চরম সঙ্কটময় মুহূর্তে জেনারেল ওসমানী আবার সামরিক পোশাক পরে বাংলাদেশ বাহিনীর নেতৃত্ব গ্রহণ করেন, যা বিশ্বে বিরল উদাহরণ।

জাতির প্রতি দায়িত্ব পালনের স্বীকৃতিস্বরূপ সরকার ওসমানীকে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর জেনারেল পদে উন্নীত করেন এবং অসাধারণ বীরত্বের জন্য ‘বঙ্গবীর’ উপাধিতে ভূষিত করেন।

১৯৭২ সালের ১০ এপ্রিল বঙ্গবীর ওসমানীকে বঙ্গবন্ধু তার মন্ত্রিসভায় জাহাজ চলাচল, অভ্যন্তরীণ নৌ ও বিমান মন্ত্রী হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করেন। ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৯৪ শতাংশ ভোট পেয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং আগের মন্ত্রণালয়সহ ডাক, তার ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বও পালন করেন। ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু সংসদীয় গণতন্ত্র বিলুপ্ত করে বাকশাল কায়েম করলে এর তীব্র প্রতিবাদ করে ওসমানী সংসদ সদস্য পদ, মন্ত্রিত্ব ও আওয়ামী লীগ থেকে পদত্যাগ করেন। ১৯৭৬ সালে ৫ সেপ্টেম্বর তার স্বপ্ন ‘সংসদীয় গণতন্ত্র’ পুনঃপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তিনি ‘জাতীয় জনতা পার্টি’ নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেন এবং ‘গণনীতির রূপরেখা’ নামে একটি বই রচনা করেন। ১৯৭৮ ও ১৯৮১ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তিনি অংশগ্রহণ করেন। পরবর্তীতে দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পেছনে ওসমানীর অবদান অসামান্য।

১৯৮৪ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি মহান জননেতা বঙ্গবীর জেনারেল এম এ জি ওসমানী লন্ডনের সেন্টপল হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন। ২০ ফেব্রুয়ারি পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাকে তার অন্তিম ইচ্ছানুযায়ী হজরত শাহজালাল রহ:-এর দরগা শরিফসংলগ্ন তার মায়ের কবরের পাশে সমাহিত করা হয়।

চিরকুমার জেনারেল ওসমানী তার সারা জীবন কাটিয়েছেন এ দেশের মাটি ও মানুষের মুক্তির জন্য, উন্নতির জন্য ও অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য। উৎসর্গ করেছেন তার জীবন-যৌবন, সহায়-সম্পত্তি ও সব কিছু। অবহেলিত বাঙালি মুসলমানদের ব্রিটিশ-ভারতীয় সেনাবাহিনীতে প্রবেশের জন্য তিনি সব প্রচেষ্টা চালিয়ে ছিলেন এবং এর সফলতাও অর্জন করেছেন ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট প্রতিষ্ঠা করার পথকে উন্মুক্ত করে এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে ১৯৪৮ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি প্রথম ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট প্রতিষ্ঠার পর একে একে এ রেজিমেন্ট সমৃদ্ধ হতে থাকে, যা স্বাধীনতা যুদ্ধে নিয়ামকের ভূমিকা পালন করে। অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে তিনি কখনো পিছু হটেননি। বাংলাদেশ পৃথিবীর বুকে যত দিন টিকে থাকবে তত দিন বঙ্গবীর জেনারেল ওসমানী বেঁচে থাকবেন এ দেশের মাটি ও মানুষের মনের মণিকোঠায় মুক্তির সুউজ্জ্বল আলোকবর্তিকা হিসেবে।

লেখক : সামরিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক
hoque2515@gmail.com

Please Share This Post in Your Social Media

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category
© All rights reserved © 2020 banglahdtv
Design & Develop BY Coder Boss