1. admin@banglahdtv.com : Bangla HD TV :
মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ০৮:৫৭ পূর্বাহ্ন

চীন-ইরান চুক্তি: নতুন স্নায়ুযুদ্ধের সূচনা!

বিশেষ প্রতিনিধি
  • Update Time : মঙ্গলবার, ৩০ মার্চ, ২০২১
  • ৪৬৪ Time View

বিশ্বের নানা প্রান্তে ঘটনাগুলো দ্রুত ঘটে চলেছে। নতুন অবয়ব নিতে শুরু করেছে অনেক কিছু। পুতিনকে খুনি আখ্যা দেয়ার জের কাটতে না কাটতে চীনের সাথে ইরানের ২৫ বছরের কৌশলগত বহুলালোচিত চুক্তি সম্পাদিত হওয়ার খবর বেরিয়েছে। তাইওয়ান ইস্যুতে চীন-মার্কিন উত্তেজনা বাড়ছে। ভারতের সাথে চীন আর পাকিস্তানের একদিকে দেখা যাচ্ছে বোঝাপড়ার চেষ্টা আবার অন্য দিকে ভারতকে আফগান শান্তি প্রক্রিয়ায় যুক্ত করার চেষ্টায় নতুন জটিলতা তৈরি হচ্ছে। ইসরাইলের নির্বাচনে নেতানিয়াহুর ভাগ্য ঝুলে আছে- তিনি সরকার গঠন করতে পারবেন নাকি প্রধানমন্ত্রিত্ব হারিয়ে মুখোমুখি হবেন বিচারের। অস্থিরতা দেখা যাচ্ছে তুরস্ক, সৌদি আরব, মিসরেও। সব কিছু অবলোকনে মনে হচ্ছে বিশ্বে নতুন কিছু ঘটা বা ঘটানোর জন্য ভেতর থেকে আয়োজন চলছে। সে আয়োজন যে নতুন এক স্নায়ুযুদ্ধের প্রারম্ভিক মেরুকরণ তাতে সন্দেহের অবকাশ কম।

চীন-ইরান ২৫ সালা চুক্তি
চীন ও ইরান শেষ পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে একটি ‘বিস্তৃত কৌশলগত অংশীদারিত্ব’ চুক্তি স্বাক্ষর করেছে যাতে পরের ২৫ বছর উভয় পক্ষের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং বাণিজ্য সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হওয়ার প্রতিশ্রুতি রয়েছে।

ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র সাঈদ খতিবজাদেহ এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, এটি দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে নতুন কৌশলগত স্তরে উন্নীত করবে। ইরানের প্রেসিডেন্ট ড. হাসান রুহানির বক্তব্যেও তারই প্রতিফলন। চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই’র সঙ্গে বৈঠকে রুহানি বলেন, দুই দেশই অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অঙ্গনসহ সব ক্ষেত্রে দীর্ঘ মেয়াদে সম্পর্ক ও সহযোগিতা জোরদারে আগ্রহী।

একই সময় ওয়াং ই বলেন, চীন সবসময় ইরানের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নকে গুরুত্ব দিয়েছে এবং মার্কিন নিষেধাজ্ঞার বিরোধিতা করে এসেছে। আমেরিকার সর্বোচ্চ চাপ হচ্ছে একটি মানবতাবিরোধী পদক্ষেপ। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এর প্রতি সমর্থন নেই।

প্রথমবারের মতো ইরান একটি বড় বিশ্বশক্তির সাথে এত দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। ২০০১ সালে ইরান এবং রাশিয়া ১০ বছরের সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষর করে যা মূলত ছিল পারমাণবিক সহায়তাকেন্দ্রিক। পাঁচ বছর মেয়াদে সময় বাড়িয়ে এটি ২০ বছর করা হয়।

চীন ও ইরানের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের পঞ্চাশতম বার্ষিকীতেই তেহরান-বেইজিং চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হলো। দুই দেশের মধ্যে আগে থেকেই উষ্ণ সম্পর্ক ছিল এবং উভয়ই ২০১৯ সালে উত্তর ভারত মহাসাগরে রাশিয়ার সাথে একটি যৌথ নৌ মহড়ায় অংশ নেয়।

ইরান ও চীন সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বছরে প্রায় ২০ বিলিয়ন ডলার বাণিজ্য করে। তেলের দাম হ্রাস এবং ২০১৮ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইরান ও বিশ্বশক্তির মধ্যে পারমাণবিক চুক্তি থেকে একতরফাভাবে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করার পরে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে ২০১৪ সালের প্রায় ৫২ বিলিয়ন ডলার থেকে এ পর্যায়ে নেমে আসে।

২০২০ সালের আগস্টে প্রস্তাবিত চুক্তি নিয়ে প্রথম আলোচনা হয়। আর সম্ভবত এটি কাকতালীয় ঘটনা নয় যে, আলাস্কায় চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের সন্ধিহীন বৈঠকের এক সপ্তাহ পরে তেহরানে চীন-ইরান এই চুক্তি স্বাক্ষর করে। এর মাধ্যমে চীন বাইডেন প্রশাসনের কাছে স্পষ্ট সঙ্কেত পাঠিয়েছে যে, ইরানের সাথে পারমাণবিক চুক্তি পুনরুদ্ধারের পাশাপাশি ইরানের ওপর তার অর্থনৈতিক চাপ কার্যকর করার ক্ষমতা চীনের সহযোগিতার ওপর নির্ভর করছে।

এর আগে চীনা বিশ্লেষকরা ১৩ জানুয়ারি পাকিস্তানি ও তুর্কি পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের মধ্যকার বৈঠককে একটি আঞ্চলিক বলয়ের সূচনা হিসেবে প্রশংসা করে বলেছিলেন, ইরানের সামনে তুর্কি-পাকিস্তান শিবিরে যোগদানের উপায় খুঁজে বের করা ছাড়া আর কোনো পথ নেই।

চীনা সামরিক বিশ্লেষকরা ৩০ কোটির বেশি জনসংখ্যার মুসলিম বিশ্বের প্রযুক্তিগতভাবে দক্ষ কর্মী অধ্যুষিত অঞ্চলে তুর্কি-ইরান-পাকিস্তান চুক্তির পূর্বাভাস দিয়েছেন। যাদের সাথে চীনা প্রভাবের যোগসূত্র থাকবে। এর একটি গুরুত্বপূর্ণ চীনা উদ্দেশ্য হলো আমেরিকান পৃষ্ঠপোষকতায় তৈরি ‘কোয়াড’ এ চীনকে নিয়ন্ত্রণ করতে ভারতের সহযোগিতা করা থেকে নিরুৎসাহিত করা। চীনা কৌশলবিদদের হিসাব অনুসারে, ইরান যদি তুর্কি-পাকিস্তানি বলয়ের দিকে মনোনিবেশ করে তাহলে ভারত বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে।

ইতোমধ্যে তুরস্কের মুদ্রা লিরা দুর্বল হয়ে পড়েছে এবং দেশটি বৈদেশিক মুদ্রার জন্য চীনের ওপর আরো কিছুটা নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। জানা যাচ্ছে, তুরস্ককে ২.৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ দেয়ার জন্য চীনা ব্যাংকগুলোর একটি কনসোর্টিয়াম প্রস্তুত। চীনের সম্ভাব্য আর্থিক সহায়তা মার্কিন-তুর্কি সম্পর্কের সচ্ছলতার সময়েই আসে। বাইডেন প্রশাসন আফগান তালেবানদের সাথে শান্তি আলোচনার কেন্দ্রস্থল কাতারের রাজধানী দোহা থেকে আঙ্কারায় স্থানান্তরিত করে এই আশায় যে তুরস্ক এ ব্যাপারে আরো সহায়ক হবে।

ট্রাম্প প্রশাসন মে মাসের মধ্যে তালেবানদের সাথে পুরোপুরি সেনা প্রত্যাহারের বিষয়ে একটি চুক্তিতে পৌঁছার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। ওয়াশিংটনের ওপর চাপ তৈরি করার জন্য তুরস্ক এখন এপ্রিল থেকে মে পর্যন্ত আফগান সরকার এবং তালেবানদের সাথে প্রথম বৈঠক স্থগিত করতে চায়। তুরস্ক রাশিয়ার কাছ থেকে এস-৪০০ বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কিনতে চায়। এ ব্যাপারে আমেরিকানদের আপত্তির বিষয়টি নিষ্পত্তি করতে চায় আঙ্কারা।

এশিয়ার ভূ-রাজনীতিতে প্রভাব
যুক্তরাষ্ট্রের রক্তচক্ষুর তোয়াক্কা না করে চীন এবং ইরানের ‘কৌশলগত সহযোগিতা’র চুক্তি এশিয়ার বিরাট অংশের ভূ-রাজনৈতিক চালচিত্র বদলে দেবে। এর আওতায় ইরানের তেল-গ্যাস, ব্যাংকিং, টেলিকম, বন্দর উন্নয়ন, রেলওয়ে উন্নয়ন এবং আরো কয়েক ডজনখানেক গুরুত্বপূর্ণ খাতে চীন ব্যাপক বিনিয়োগ করবে। এই বিনিয়োগের পরিমাণ আগামী ২৫ বছরে কমপক্ষে ৪৪ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ হতে পারে।

সেই সাথে প্রস্তাবিত চুক্তিতে সামরিক ও নিরাপত্তার ক্ষেত্রে সহযোগিতার কথা উল্লেখ করা হয়েছে যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে এ নিয়ে এখন পর্যন্ত কিছু বলা হয়নি। এর আগে মিডল-ইস্ট আই নিউজ ওয়েবসাইটের রিপোর্টে বলা হয়েছিল, চুক্তির আওতায় চীন তাদের বিনিয়োগের সুরক্ষায় ইরানে পাঁচ হাজার পর্যন্ত সৈন্য মোতায়েন করতে পারবে। এর মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যে এই প্রথম সরাসরি চীনা সামরিক উপস্থিতির সম্ভাবনা তৈরি হবে। এটি এবং চীনাদের কাছে একটি ইরানি দ্বীপ ইজারা দেয়ার বিষয় তেহরানের নেতারা সরাসরি অস্বীকার করেছেন। স্বাক্ষরিত চুক্তিতে এ ধরনের কিছু আছে কি না এখনও নিশ্চিত নয়।

আন্তর্জাতিক উত্তর-দক্ষিণ পরিবহন করিডোর নামে ইরান ও রাশিয়ার একটি প্রকল্পে অংশীদারিত্ব রয়েছে। চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের সুবিধাগুলোতে রাজনৈতিক ও ধর্মীয় পার্থক্য ছাড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ইরান ও পাকিস্তানের মধ্যে মুক্তবাণিজ্য রেলপথ ও বন্দরগুলোর কারণে উভয় দেশে সম্ভাব্য বিকাশ ঘটতে পারে। আফগানিস্তানে শান্তি প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে সম্ভাব্য চুক্তিটি পাকিস্তান ও চীনের ওপর ভারতের চাপও শিথিল করবে।

মধ্যপ্রাচ্যের ওপর প্রভাব
চীন ঐতিহ্যগতভাবে মধ্যপ্রাচ্যের সাথে রাজনৈতিকভাবে যুক্ত ছিল না। মধ্যপ্রাচ্যের প্রায় সব দেশের সাথে চীনের কম বেশি অর্থনৈতিক সম্পর্ক ছিল। ইরানের সাথে চুক্তির মাধ্যমে বেইজিংয়ের মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হলো। চীন ইসরাইল-ফিলিস্তিন এবং সংশ্লিষ্ট অন্য পক্ষগুলোর অংশগ্রহণে বেইজিং সম্মেলনের প্রস্তাব দিয়েছে। এ প্রস্তাব মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে চীনের সম্পৃক্ত হওয়ার আকাক্সক্ষারই ইঙ্গিত।

ইরানের সাথে এ চুক্তি অন্যান্য আঞ্চলিক খেলোয়াড়ের স্বার্থের সাথে যে সঙ্ঘাত তৈরি হবে তার শীর্ষে রয়েছে সৌদি আরব। বিআরআই-এর সাথে অন্যান্য উপসাগরীয় এবং মিসরের মতো দেশও অন্তর্ভুক্ত। সৌদি আরব বিশেষভাবে চীনের সাথে সম্পর্ক বাড়াতে একাধিক উদ্যোগ নিয়েছে। সৌদি তেলের প্রধান গ্রাহক যুক্তরাষ্ট্র তেল কেনা বন্ধ করে দেয়ায় জ্বালানি বিক্রির বাজার হিসেবে রিয়াদ টার্গেট করেছিল চীন এবং ভারতকে। ভারতের সাথে সৌদি আরব জ্বালানি খাতে একাধিক বিনিয়োগ চুক্তি করেছে। অতি সম্প্রতি তারা চীনে আগামী ৪০ বছর তেল সরবরাহের অঙ্গীকার করেছে। বেইজিং ইরানের সাথে সৌদি বিরোধ নিরসনে মধ্যস্থতা করে সৌদির নিরাপত্তার ব্যাপারে ওয়াশিংটননির্ভরতা কমানোর জন্য কাজ করছে বলে মনে হয়। ইয়েমেনের যুদ্ধ অবসানে দুই পক্ষের মধ্যে সমঝোতার আভাস মিলছে। এটি হলে তা মধ্যপ্রাচ্যে চীনা কূটনীতির বড় সাফল্য হিসেবে গণ্য হতে পারে।

ইরান কেন এই পথে
ওয়াশিংটনে আরব গাল্ফ স্টেটস ইনস্টিটিউটের সিনিয়র ফেলো আলি আলফোনেহ বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞায় দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ায় ইরান অস্তিত্বের স্বার্থে চীনের দ্বারস্থ হয়েছে। জ্বালানি তেল ও গ্যাস মজুদের হিসাবে ইরান বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ দেশ হলেও যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞায় জ্বালানি বিক্রি করা দুরূহ হয়ে পড়েছে। সেই সাথে বিনিয়োগের অভাবে তেলক্ষেত্র উন্নয়নের পথও কার্যত বন্ধ। চীনা বিনিয়োগ তাদেরকে সেই ‘মহাসঙ্কট’ থেকে বের করে আনতে পারবে।

চীনের স্বার্থ কী
২০১৬ সালে শি জিন পিংয়ের ইরান সফরের সময় ‘কৌশলগত সহযোগিতা চুক্তি’ নিয়ে প্রথম দুই সরকারের মধ্যে প্রাথমিক বোঝাপড়া হয়। কুয়ালালামপুরে মালয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব চায়নার অধ্যাপক ড. মাহমুদ আলি বলেন, “চীন তাদের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’ প্রকল্পে ইরানকে জোরালোভাবে আনার জন্য অনেক দিন ধরেই চেষ্টা করছে। মালাক্কা প্রণালী দিয়ে তাদের বাণিজ্য, বিশেষ করে জ্বালানি সরবরাহের নির্ভরতা কমানোর জন্য চীন বহু দিন ধরে উদগ্রীব, কারণ ওই সমুদ্র রুটটির নিয়ন্ত্রণ এখনো যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্রদের হাতে। ইরানকে পাশে পেলে সমুদ্র রুটকে পাশ কাটিয়ে জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করা চীনের জন্য অনেক সহজ হবে। চীনের জন্য এটি বিরাট এক ভূ-রাজনৈতিক উদ্যোগ।”

ইতোমধ্যেই অবশ্য চীন ও ইরানের মধ্যে সরাসরি রেল লিংক তৈরি হয়েছে। ‘নতুন সিল্ক রোড’ নামে পরিচিত এই রেল রুট শিনজিয়াং থেকে কাজাখস্তান, উজবেকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, কিরগিস্তানকে যুক্ত করে তেহরান পর্যন্ত ২৩০০ কিলোমিটার দীর্ঘ। চীনা কোম্পানি সিনোম্যাক পশ্চিম ইরানে নতুন একটি রেললাইন তৈরির চুক্তি সই করেছে। তবে বেইজিংয়ের সবচেয়ে বড় প্রকল্প তেহরান এবং মাশাদের মধ্যে ৯২৬ কিলোমিটার রেললাইনের বিদ্যুতায়ন। তেহরান-কোম-ইস্পাহানের মধ্যে একটি দ্রুতগতির রেলপথ নির্মাণেরও কথা হচ্ছে। এসব রেল প্রকল্প ‘নতুন সিল্ক রোড’-এর অংশ হবে।

এই সম্পর্কের প্রভাব কী হবে?
এই চুক্তির ফলে ইরানের অর্থনীতির প্রভূত উন্নতি হবে। তাদের রাজনীতি স্থিতিশীল হবে। ইরানের সাথে দ্বন্দ্বের ব্যাপারে অনেক দেশের আগ্রহ কমবে। এমনকি উপসাগরের অনেক দেশ চীনের সাথে এই ধরনের চুক্তিতে আগ্রহী হতে পারে।

চীন-ইরান এবং পাকিস্তানের মধ্যে খুব ধীরে হলেও নিশ্চিতভাবে একটি কৌশলগত জোট দানা বাঁধছে। এর সাথে অদূরভবিষ্যতে যুক্ত হতে পারে আফগানিস্তান, ইরাক এবং সিরিয়া। নতুন এই ভূ-রাজনৈতিক সম্ভাবনা যুক্তরাষ্ট্র তো বটেই, তার মিত্র ভারতের জন্যও মাথাব্যথার কারণ হতে পারে।

সুয়েজ খালের বিকল্প প্রস্তাব
ইরান-চীন চুক্তি স্বাক্ষর হওয়ার পরই ইরান এক তাৎপর্যপূর্ণ প্রস্তাবে বলেছে, এশিয়া থেকে ইউরোপে পণ্য পরিবহনের জন্য সুয়েজ খালের তুলনায় প্রস্তাবিত নর্থ-সাউথ করিডোর বা এনএসটিসি রুটের ঝুঁকি অনেক কম এবং অনেক বেশি লাভজনক। সুয়েজ খালে একটি বিশাল জাহাজ আড়াআড়িভাবে আটকে পড়ার কারণে কয়েক দিন ধরে সেখানে অসংখ্য জাহাজের জট তৈরি হয় এবং এর ফলে প্রতিদিন শত শত কোটি ডলারের ক্ষতি হয়।

মস্কোয় নিযুক্ত ইরানি রাষ্ট্রদূত কাজেম জালালি শনিবার এক টুইটার বার্তায় লিখেছেন, জাহাজ, রেল ও সড়কপথের সমন্বয়ে তৈরি হওয়া এ রুটে পণ্য পরিবহনের খরচ শতকরা ৩০ থেকে ৬০ ভাগ কমবে। এ ছাড়া, বর্তমানে সুয়েজ খাল দিয়ে পণ্য পরিবহনে ৪০ দিন সময় লাগলেও প্রস্তাবিত রুটে সময় লাগবে মাত্র ২০ দিন। ইরানের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় চবাহার সমুদ্রবন্দর এই রুট বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারবে। ইরানের পাশাপাশি ভারত ও রাশিয়ার পক্ষ থেকে নর্থ-সাউথ ট্রান্সপোর্ট করিডোর বা এনএসটিসি রুটের পরিকল্পনা তুলে ধরা হয়েছে। ২০০০ সালে ৭,২০০ কিলোমিটার দীর্ঘ বহুমুখী এই রুটের প্রস্তাব করা হয়। পরবর্তীতে মধ্য এশিয়ার ১০টি দেশ এই পরিকল্পনায় যুক্ত হয়।

১৬ দেশের মার্কিনবিরোধী জোট
সাম্প্রতিক আরেকটি খবর হলো- রাশিয়া, চীন ও ইরানসহ ১৬টি দেশ জোটবদ্ধ হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে। জাতিসঙ্ঘকে ব্যবহার করে আমেরিকা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিরুদ্ধে যে হুমকি ও নিষেধাজ্ঞা দিয়ে আসছে তা মোকাবেলার জন্য এই জোট। জোটে থাকছে, সিরিয়া, ফিলিস্তিন, উত্তর কোরিয়া, ভেনিজুয়েলা, কিউবা, আলজেরিয়া, অ্যাঙ্গোলা, বেলারুশ, বলিভিয়া, কম্বোডিয়া, ইরিত্রিয়া, লাওস, নিকারাগুয়া, সেন্ট ভিনসেন্ট এবং গ্রেনাডিন্স দ্বীপপুঞ্জ। এই জোট নতুন এক স্নায়ুযুদ্ধের মেরুকরণের পদক্ষেপ তাতে সন্দেহ নেই।

পাল্টে যাচ্ছে অনেক কিছু
চীন-ইরান চুক্তি বিশ্ব পরিস্থিতির অনেক হিসাব নিকাশ পাল্টে দিতে পারে। বাইডেনের ক্ষমতায় যাওয়ার মূল অঙ্গীকার, ‘চেনা আমেরিকাকে ফিরিয়ে আনা’। এই লক্ষ্য অর্জনে তিনি পুরনো মিত্রদের আস্থা ফেরানোর চেষ্টা করছেন। আন্তর্জাতিক অঙ্গীকার পালনে তার দেশকে পুরনো ট্র্যাকে ফিরিয়ে আনছেন। আর চীন-রাশিয়া দুই শক্তিকে সমান্তরাল প্রতিপক্ষ হিসেবে চিহ্নিত করছেন। এর অনিবার্য প্রতিক্রিয়া হলো পাল্টা শক্তিগুলোর নিজেদের নিয়ে ভিন্ন বলয় তৈরি করা। রাশিয়ার প্রতিরক্ষা সামর্থ্য এবং চীনের অর্থনৈতিক শক্তিমত্তা এক হয়ে নতুন বলয় নির্মাণে আগ্রাসী হতে শুরু করলে দ্বিতীয় পর্যায়ের স্নায়ুযুদ্ধ অনিবার্য। তবে স্নায়ুযুদ্ধের দুই প্রতিপক্ষের কিছু সীমাবদ্ধতা এবং সুবিধা রয়েছে। কোন দেশে গণতন্ত্র বা মানবাধিকার আছে সে সবের তোয়াক্কা করার প্রয়োজন পড়ে না চীন-রাশিয়ার। ফলে কর্তৃত্ববাদী সরকারগুলো এই বলয়ের সাথে মৈত্রী করতে কোনো চাপের মধ্যে পড়ে না। তবে বিদ্যমান আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক ও বৈশ্বিক কাঠামোতে এই বলয়ের প্রভাব এখনো গৌণ। যদিও ডলারের বিকল্প আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মুদ্রার উত্থান এই ভারসাম্যে পরিবর্তন আনতে পারে যে চেষ্টা চীন-রাশিয়া যৌথভাবে চালিয়ে যাচ্ছে। নতুন চুক্তি অনুসারে চীন-ইরান বাণিজ্যে ডলারের কোনো ভূমিকা থাকবে না। অবশ্য চীন বৈশ্বিক অর্থনীতিতে এখনো যতটা না ভোক্তা তার চেয়ে বেশি সরবরাহকারী। ফলে চীন-রাশিয়ার সাথে বলয়বন্দী হওয়া মানে ইউরোপ আমেরিকার বাজার এবং অভিবাসনের সুযোগ সঙ্কুুচিত হওয়া। এই টানাপড়েনের মধ্যেই মাঝামাঝি যেসব উদীয়মান এবং উল্লেখযোগ্য শক্তিমত্তার দেশ রয়েছে তারা কোন বলয়ে এখনি একাত্ম না হয়ে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে। তবে ‘না ঘরকা না ঘাটকা’ অবস্থায় মধ্যবর্তী দেশগুলোর বেশি দিন থাকার অবকাশ থাকবে বলে মনে হয় না। বৈশ্বিক পরিস্থিতি এখন দ্রুত বদলাতে শুরু করেছে। চীন-ইরান চুক্তি হতে পারে এ ক্ষেত্রে অনেক বড় একটি বড় ঘটনা।

Please Share This Post in Your Social Media

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category
© All rights reserved © 2020 banglahdtv
Design & Develop BY Coder Boss