চিকিৎসা পেতে প্রথমে হাসপাতালের বাইরে লাইন দিতে হয়েছিল। মৃত্যুর সাথে যখন পাঞ্জা লড়ছেন, তখন হাসপাতালের বাইরে অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন তাদের পরিজনরা। মৃত্যুর পরেও ওই লাইন থেকে নিস্তার পেলেন না ভারতের দিল্লিতে করোনার কবলে প্রাণ হারানোরা। চিতায় ওঠার জন্যও মাচায় শুয়ে থাকা অবস্থাতেই শ্মশানে লাইন দিতে হল তাদের। অতিমারীতে বিধ্বস্ত রাজধানীতে এ বার এমনই দৃশ্যই সামনে এল।
৪০ ডিগ্রির উপরে হাঁসফাঁস করা গরমে মঙ্গলবার দিল্লিতে কী দৃশ্য ধরা পড়ল? সুভাষনগর শ্মশানে টিনের চালের নিচে সারি সারি চিতা জ্বলছে। মিহি ছাই উড়ে এসে পড়ছে পাশের চাতালেও। আর খাঁ খাঁ রোদে তেতে ওঠা ওই চাতাল ধরেই এগিয়েছে লাশে সর্পিল রেখা। এক ঝলক তাকালেই মাচার সাথে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা ১৫-২০টি লাশ চোখে পড়তে বাধ্য।
পাশের উচু বাঁধানো জায়গায় ঘি এবং প্রয়োজনীয় সামগ্রী নিয়ে বসে রয়েছেন পরিজনরা। এক দু’ঘণ্টা নয়, ১৬ থেকে ২০ ঘণ্টা বসে রয়েছেন কেউ কেউ। যে প্লাস্টিকের থলিতে লাশ মোড়া রয়েছে, তার উপর নাম, নম্বর লেখা থাকায় হাতছাড়া হওয়ার ভয় নেই। তাই একটানা বসে না থেকে বাইরে থেকে মাঝেমধ্যে পোড়া লাশের গন্ধ এবং ধোঁয়া থেকে বেরিয়ে আসছেন অনেকে।
কিন্তু বাইরে বেরিয়েও যে প্রাণভরে শ্বাস নেবেন তার উপায় নেই। সেখানেও লাশ নিয়ে সারি সারি অ্যাম্বুল্যান্স এবং গাড়ি দাঁড়িয়ে রয়েছে। তখনও ধাক্কা সামলে উঠতে না পারা কয়েকজন ফোঁপাচ্ছেন। কোনখানে দাঁড়াবেন বুঝতে পারছেন না। তাতে বাকিরাও রীতিমতো অপ্রস্তুত।
এমন সময় বেরিয়ে এলেন শ্মশানের এক কর্মী। কড়া স্বরে বললেন, ‘অপনা অপনা ডেড বডি উঠাও অউর উধর লাইন মেঁ জা কে খড়ে হো জাও।’ তাতে প্লাস্টিকে মোড়া বাবার দেহের উপর চন্দনকাঠ সাজাতে গিয়ে থতমত খেয়ে গেলেন এক নারী। কোনটা নাভি আর কোনটা বুক, বুঝে উঠতে পারছিলেন না। তাকে ধমক লাগালেন অন্য এক শ্মশানকর্মী। তাতে ফুঁপিয়ে উঠলেন ওই মহিলা। কান্না চাপতে চাপতে বললেন, ‘বাবার মুখটা পর্যন্ত দেখতে পাইনি।’
এদিকে, সোমবার সন্ধ্যায় সুভাষনগর শ্মশানে বাবার লাশ নিয়ে আসেন ব্যবসায়ী আমন অরোরা। হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তার বাবা এমএল অরোরার মৃত্যু হয়। কিন্তু একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করতে গেলে আগে কোভিড রিপোর্ট জমা দিতে বলা হয়। কিন্তু নমুনা পরীক্ষা করার আগেই বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু হয় তার। তার পর সন্ধ্যা পেরনোর আগেই শ্মশানে এসে পৌঁছান তিনি। কিন্তু মঙ্গলবার সকালের আগে দাহ করা সম্ভব নয় বলে তাকে জানিয়ে দেন শ্মশানের কর্মীরা। কিন্তু ততক্ষণে পচন ধরতে পারে ভেবে একটি ফ্রিজ ভাড়া করে শ্মশানের বাইরেই বাবার লাশ সংরক্ষণ করে রাখেন তিনি। মঙ্গলবার বিকেলে শেষমেশ বাবার সৎকার করতে পারেন তিনি।
দিল্লি সরকারের হিসেব অনুযায়ী, মাস দুয়েক আগেও পরিস্থিতি যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণে, ৫৭ জন করোনা রোগীর মৃত্যু হয়। মার্চে সংখ্যাটা বেড়ে হয় ১১৭। কিন্তু এপ্রিল মাস এখনো শেষ হয়নি, তাতেই কোভিডে আক্রান্ত হয়ে ৩ হাজার ৬০১ রোগী মারা গেছেন। এর মধ্যে গত ৭ দিনেই মৃত্যু হয়েছে ২ হাজার ২৬৭ জনের। যদিও সরকারি পরিসংখ্যান নিয়েও গরমিলের অভিযোগ উঠে আসছে।
Leave a Reply