ভারতের রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলোর মধ্যে কাশ্মির ছাড়া একমাত্র মুসলিম-প্রধান এলাকা হলো লাক্ষাদ্বীপ। আর অপূর্ব নৈসর্গিক সৌন্দর্যে মোড়া এই শান্ত দ্বীপপুঞ্জ হঠাৎ করেই কিছুদিন ধরে ভারতে খবরের শিরোনামে।
আরব সাগরের বুকে গোলাকৃতি ৩৬টি কোরাল দ্বীপ (অ্যাটল) নিয়ে গঠিত এই লাক্ষাদ্বীপ, আর কেন্দ্রীয় সরকারের নিযুক্ত একজন প্রশাসকই এখানে সরকারের দৈনন্দিন কাজকর্মের তদারকি করে থাকেন।
সাধারণত খুব সিনিয়র আমলা বা আইপিএস অফিসাররাই এই দায়িত্ব পেয়ে থাকেন, তবে সেই ধারায় ব্যতিক্রম ঘটিয়ে গুজরাটের একজন সাবেক বিজেপি নেতাকে এই পদটি দেয়া হয়েছে।
গত ছয় মাস ধরে লাক্ষাদ্বীপে সেই প্রশাসকের দায়িত্ব পালন করছেন প্রফুল খোডা প্যাটেল, যিনি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহর ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত।
২০১২ সালে সোহরাবউদ্দিন শেখ এনকাউন্টার কেসে যখন অমিত শাহকে জেলে যেতে হয়েছিল, তখন গুজরাটের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্বও পেয়েছিলেন এই প্রফুল খোডা প্যাটেল।
আরব সাগরের বুকে লাক্ষাদ্বীপের দায়িত্ব হাতে নিয়েই তিনি এমন কয়েকটি বিতর্কিত পদক্ষেপ নিয়েছেন, যার বিরুদ্ধে ওই দ্বীপপুঞ্জের বাসিন্দারা এখন ক্ষোভে ফুঁসছেন।
সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়াতে তারা ‘সেইভ লাক্ষাদ্বীপ’ ক্যাম্পেনও শুরু করেছেন, যাতে পার্শ্ববর্তী কেরালার বহু তারকা ও রাজনীতিবিদরাও সমর্থন জানাচ্ছেন।
ভারতের বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ শারদ পাওয়ার প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লিখে লাক্ষাদ্বীপের প্রশাসককে সরিয়ে দেয়ার আর্জি জানিয়েছেন। দেশের রাষ্ট্রপতির কাছেও একই দাবি জানিয়েছেন কেরালার বিভিন্ন দলের এমপিরা।
কিন্তু প্রফুল খোডা প্যাটেল মাত্র ছয়মাসের মধ্যে কী এমন করেছেন যাতে লাক্ষাদ্বীপ তার বিরুদ্ধে এভাবে বিদ্রোহ করে বসেছে?
তার নানা বিতর্কিত পদক্ষেপের এই তালিকা আসলেই বেশ দীর্ঘ।
– নতুন প্রশাসক প্রস্তাব করেছেন, লাক্ষাদ্বীপে গরুর গোশত বা বিফ খাওয়া নিষিদ্ধ করতে হবে।
– জনসংখ্যার ৯৮ শতাংশ যেখানে মুসলিম, সেই লাক্ষাদ্বীপে এখন মদ্যপান নিষিদ্ধ। কিন্তু নতুন প্রশাসক চান লাক্ষাদ্বীপের বিলাসবহুল হোটেল ও রিসোর্টগুলো অ্যালকোহল পানীয় পরিবেশনের অনুমতি পাক।
– যাদের দুটির বেশি সন্তান আছে, তাদের পঞ্চায়েত নির্বাচনে লড়ার অধিকার থাকবে না।
– স্কুলে মিড-ডে মিলে এখন ডিম-মাছ-গোশতের মতো আমিষ খাবার দেয়া হলেও তার জায়গায় শুধু নিরামিষ খাবার দেয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে।
– গত বছর লাক্ষাদ্বীপে যারা ভারতের নাগরিকত্ব আইন ও এনআরসির বিরুদ্ধে বিক্ষোভে অংশ নিয়েছিলেন, তাদের বেশ কয়েকজনকে সম্প্রতি গ্রেফতার করা হয়েছে।
– লাক্ষাদ্বীপে ‘ক্রাইম রেট’ বা অপরাধের ইতিহাস প্রায় শূন্যের কাছাকাছি – অথচ সেখানে এমন একটি আইন আনার প্রস্তাব করা হয়েছে যাতে দ্বীপের প্রশাসক যে কাউকে এক বছর পর্যন্ত বিনা বিচারে আটকে রাখার ক্ষমতা পাবেন। সাধারণভাবে এই আইনটি ভারতে ‘গুন্ডা আইন’ নামেই পরিচিত।
– উন্নয়নের নামে লাক্ষাদ্বীপ প্রশাসন ব্যক্তি মালিকানার যেকোনো জমি অধিগ্রহণ করে নিতে পারবে।
এতেই শেষ নয়, গত বছর লাক্ষাদ্বীপ বাইরে থেকে আসা প্রত্যেকের জন্য যে বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টাইন ব্যবস্থা চালু করেছিল নতুন প্রশাসক আসার পর সেটাও তুলে দিয়েছেন।
ফল হয়েছে এই, গোটা ২০২০ সালে যেখানে পুরো লাক্ষাদ্বীপে একজনও পজিটিভ কোভিড রোগী ছিল না, এখন সেখানে প্রশাসন প্রায় ৭ হাজার অ্যাক্টিভ কেস নিয়ে হাবুডুবু খাচ্ছে।
লাক্ষাদ্বীপের এমপি মোহাম্মদ ফয়সাল বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, ‘আমাদের দ্বীপপুঞ্জের মানুষের যে আচার, সংস্কৃতি বা খাদ্যাভাস – সেখানে কেন প্রশাসন হস্তক্ষেপ করতে চাইছে?’
‘লাক্ষাদ্বীপ যেখানে মদ খাওয়া পছন্দ করে না, সেখানে কেন অ্যালকোহলের অনুমতি দেয়া হচ্ছে?’
‘আমাদের দ্বীপে গুন্ডা আইন আনার কোনো প্রয়োজনই নেই, অথচ তারপরও স্রেফ মানুষকে ভয় দেখাতে এসব আইন আনা হচ্ছে!’
তিনি মনে করছেন, প্রশাসক প্রফুল খোডা প্যাটেল লাক্ষাদ্বীপের নিজস্ব সংস্কৃতিকে আঘাত করেছেন বলেই তার বিরুদ্ধ জনমত এভাবে রুখে দাঁড়িয়েছে।
গত কয়েকদিনে ফেসবুক, টুইটারের মতো সোশ্যাল মিডিয়ায় শত শত দ্বীপবাসী ‘সেইভ লাক্ষাদ্বীপ’ ক্যাম্পেইনে সামিল হয়েছেন। তারা গান বাঁধছেন, কবিতা লিখছেন, দাবি জানাচ্ছেন প্রশাসককে সরানোর।
কেরালার সাথে লাক্ষাদ্বীপের সাংস্কৃতিক ও অন্যান্য যোগাযোগ খুব নিবিড়, লাক্ষাদ্বীপের বেশির ভাগ মানুষ মালয়লাম ভাষাতেই কথা বলেন।
সেই কেরালার মেগা-তারকা ও সিনেমা অভিনেতা পৃথ্বীরাজও এই ‘সেইভ লাক্ষাদ্বীপ’ ক্যাম্পেইনকে সমর্থন করছেন।
কেরালার বামপন্থী এমপি ভিনয় বিশ্বমও মনে করছেন, নতুন প্রশাসক আসলে মুসলিম-প্রধান লাক্ষাদ্বীপে একটি সাম্প্রদায়িক এজেন্ডা বাস্তবায়নের লক্ষ্য নিয়েই কাজ করছেন।
বিবিসিকে তিনি বলছিলেন, ‘পরিষ্কার বোঝাই যাচ্ছে প্যাটেল বিজেপি ও আরএসএসের দালাল হিসেবে লাক্ষাদ্বীপে কাজ করতে এসেছেন। তার আনুগত্য বিজেপির প্রতি, দেশের সংবিধানের প্রতি নয়।’
পরিস্থিতি এতটাই জটিল হয়ে উঠেছে যে লাক্ষাদ্বীপে বিজেপির যুব শাখার আটজন নেতাও একসাথে প্রতিবাদ জানিয়ে পদত্যাগ করেছেন।
তাদের ইস্তফাপত্র আবার টুইট করেছেন কংগ্রেস নেতা ও এমপি শশী থারুর।
প্রফুল খোডা প্যাটেলের কার্যালয় বা ক্ষমতাসীন বিজেপির পক্ষ থেকে লাক্ষাদ্বীপ পরিস্থিতি নিয়ে এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো মন্তব্য করা হয়নি।
কিন্তু ইতিমধ্যে ভারতের এই মুসলিম-অধ্যুষিত দ্বীপপুঞ্জে তাদের নিজস্ব আচার-সংস্কৃতি, জীবনধারা ও রীতি-রেওয়াজ রক্ষার আন্দোলন ক্রমেই তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে উঠছে।
সূত্র : বিবিসি
Leave a Reply